গল্প- 'ট্রেনের হুইসেল' by হামিদুল ইসলাম

আপাতত: আমাদের মূল আকর্ষণ ট্রেন। একটু পরই চলে আসবে ওটা। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের মাঝখান চিরে চলে গেছে রেললাইন। একদম সোজা।
তীক্ষ হুইসেল বাজিয়ে ছুটে যাবে ট্রেন। একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিশাল বাতাসের ধাক্কায় আমরা একটু বিচলিত হবো। হঠাৎই সেই ধাবমান ট্রেনের কামরার জানালায় ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠবে কটি কচিকাচা মুখ।
তাদের বয়সী আমাদের এমন খোলাপ্রান্তরে বাতাসের সাথে উড়তে দেখে সোল্লাসে হাত নাড়বে। কখনো কখনো গাড়ির শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে উঠবে। আমরাও প্রবল আবেগে হাত নাড়বো। কোন্ নাম না জানা অচেনা শহরের অথবা গাঁ’র ছোট্ট বন্ধুরা হঠাৎই মিলিয়ে যাবে। মাত্র দু’তিন মিনিট! চলে যাচ্ছে ট্রেন। ক্রমশই ক্ষীয়মান হচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে ধোয়া। সবকিছু আবার সুনসান। অবারিত ধান ক্ষেতে তখন শুধুই বাতাসের দাপাদাপি।

আমাদের এই জেলাশহর তখনো জেলা হয়নি। মহকুমা শহর। বলতে পারো শহুরে গন্ধমাখা গ্রাম। জামালপুর। কিছু রেলে জংশন স্টেশনের জন্য এর আলাদা কদর ছিল।

ঢাকা ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর এখান থেকে ভাগ হয়েছে লাইন। এক লাইন চলে গেছে সরিষাবড়ি জগন্নাথগঞ্জ হয়ে সিরাজগঞ্জে। অন্য লাইন দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ হয়ে রংপুর দিনাজপুর। সুতরাং প্রায় সারা দিনরাতই ট্রেনের হুইসেল আমাদের সচকিত করতো। পড়াশোনার ফাঁকে বিকেলটাই ছিল আমাদের কিশেঅরকালের স্বাধীন সময়। স্কুল থেকে ফিরে সামান্য টিফিন মুখে দিয়ে পাশাপাশি বাসার সহপাঠী বন্ধুরা ছুটে যেতাম শহরতলীর রেললাইনের ধারে, দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেতে যেখানে আকাশ এসে মিশেছে।

আশে পাশে ক’মাইলের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি নেই। বুক সমান ধানের ক্ষেতের আল ধরে রেললাইনের উঁচু জমিনে দাঁড়িয়ে লোহার বিছানো পাতের ওপর দু’বন্ধু দু’দিকে মাঝে ধরাধরি করে সমান্তরাল হেঁটে যাওয়া। সে কি রোমাঞ্চ! এরই মাঝে প্রায় নির্ধারিত সময়ে ছুটে আসা ট্রেনকে সমীহ করে লাইনটা ছেড়ে দিতে হয়। তখন অন্য ধরনের রোমাঞ্চ। ধাবমান ট্রেনের কামরায় তখন আমাদের কৈশরের অবাক চোখ খুঁজে ফেরে অচেনা নাম না জানা কিশোরদের।

এর মাঝে একদিন আমাদের বন্ধু হারুন চোখ বড় বড় করে খবর দিল, জানো, তুমি যদি একটি সিকি (২৫ পয়সার মুদ্রা) ছুটন্ত ট্রেনের চাকার নিচে পেতে রাখো- ট্রেন চলে যাবার পর ওটা আধুলি (৫০ পয়সার মুদ্র) হয়ে যাবে।

বলে কী? একবারে ডবল! সুতরাং আমাদের পায় কে? বহুকষ্টে যোগাড় হলো দুই সিকির কয়েন। ছুটে যাই রেললাইনের ধারে। আমরা কি একটু জলদি চলে এসেছি? না হলে ট্রেন দেরি করছে কেন? নাকি অন্য কিছু?

লাইনে কান পাতি। দূরাগত ট্রেনের শব্দ শোনার সে কি দুর্নিবার আকাক্সক্ষা! হঠাৎই দিগন্ত রেখায় কালো ধোয়ার হালকা রেশ, তারপরই স্পষ্ট হতে থাকে ট্রেনের শব্দ। আকাক্সক্ষার দানবটা ছুটে আসছে। আমরা প্রচণ্ড থ্রিল নিয়ে রেলের চওড়া পাতের ওপর দু’দুটো সিকি পেতে রেখে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসি। প্রতিদিনের মতো জানালায় নয় আজ সবার সব ক’টা উৎসুক চোখ রেলের পাতের দিকে। যথারীতি যান্ত্রিক দানবটা তুমুল শব্দ আর হাওয়ার ঝঢ় তুলে ছুটে যায়।

পাথর বিছানো লাইন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ধূসর হয়ে যায়। ধূলোর রেশ কাটার আগেই আমাদের পাঁচজোড়া বিস্ফোরিত চোখ রেলপাতের ইতিউতি খুঁজতে থাকে সেই আধুলি বনে যাওয়া সিকি দু’টোকে। কিন্তু কোথায় কী! রেললাইন আর বগির লোহার চাকার তুলকালাম ঘর্ষনে ধূলিসাৎ সিকি দু’টো যে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে! হতাশ পাঁচজোড়া চোখ তবুও বিশ্বাস করতে চায় না। সুতরাং সন্ধ্যের অন্ধকার নামার আগ পর্যন্ত চললো খোঁজা।

দোষ তো আর ট্রেনের নয়। তাই এমন পয়সা ডবল হওয়ার ভোজবাজি দেখার সুযোগ আর হলো না।

ট্রেন ছুটে যায় তার গন্তব্যে। গন্তব্য কোথায়? কখন ফিরে আসে? যেই ভাবা সেই কাজ। স্টেশন তো পাশেই। চেপে বসো। নিয়ে যাক একদিন। ভাগ্যিস, এ ট্রেন যায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত। এরপর নদী। নদীতে আছে ফেরি। ঐ দিকে বাবা পা বাড়াবো না। ঘাট পর্যন্ত তো যাওয়া যাক; ঘণ্টাখানেক পর ফেরির যাত্রী নিয়ে ও আবার এদিকে আসবে। আমরাও ফিরবো। কিন্তু টিকেট! টিকেট ছাড়া তো ট্রেনে ওঠা যাবে না। কিন্তু বহু ভেবে যুক্তিও একটা দাঁড় করালাম। আমরা তো আর তথাকথিত যাত্রী নই। মিছেমিছি। সুতরাং টিকেট না কাটলেও চলবে।

চাপলাম ট্রেনে। যথারীতি ছুটেও চলল সেটা। এতদিন নিচ থেকে ট্রেনরে জানালা খুঁজে বেরিয়েছি। আজ সেই ফ্রেম চোখে। জানালা দিয়ে অবারিত ধানক্ষেত। তীরবেগে সব নেই হয়ে যাচ্ছে। মাঠগুলো যেন ঘুরে ঘুরে নদীর ঘূর্ণির মতো হারিয়ে যাচ্ছে। ারে মাঝেই ঝম ঝম করে শব্দ। ব্যাপার কী! জানালার ফ্রেমে ঝাপিয়ে পড়লাম সবাই। একটি সেতু পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। বিশাল সেতু। ঝিনাই নদীর উপর ব্রিজ। তাইতো এমন শব্দ। রাজকীয় চালে পেরিয়ে এলাম সেতু। এর মাঝেই বিড়ম্বনা! দেখি, ট্রেনের টিটি সাহেব। সবার টিকেট চেক করছেন। আমরাতো ভয়ে অস্থির!

টিকেট না পেলে কি করবে আমাদের? কিন্তু অবাক করে দিয়ে টিটি মশাই বড় অবজ্ঞাভরে আমাদের অতিক্রম করে গেলেন। এই ছোট ছোট কিশোরদের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকারই করলেন না। যাক্ বাবা, বাঁচা গেল!

এই ভাবে অবাক হতে হতে কখন যে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাটে এসে গেছি বুঝতে পারিনি। সবাই লাগেজ নিয়ে নেমে যাচ্ছে দেখে আমরাও নামলাম। বিরান এক বালির চরের মাঝে এক স্টেশন। এর আগে ঘাটে ফেরি এসেছে। সুতরাং ট্রেনের বগি ভরতে দেরি হলো না। আবার ফিরে চলা। কিন্তু এ কী! ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম বিকেল বেলা অফুরন্ত। এর শেষ নেই। বিকেলে ট্রেনে চেপে বিকেলেই চলে আসবো কিন্তু হলো কই?

সন্ধ্যের আলো-আধাঁর তারপর সত্যি সত্যি অন্ধকারের বুক চিরে চলছে ট্রেন। এবার আর ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য অবলোকন নয়। ভয়টা জেকে বসল এই ভেবে যে, বাসায় কি জবাব দেব? এতক্ষণে সবার বাড়িসুদ্ধ লোক গভীর চিন্তায় পড়ে গেছেÑ আমরা কোথায় গেলাম! সব্বাই গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। থেকে থেকে ট্রেনের তীক্ষ হুইসেল আমাদের বাস্তবে ফিরিয়ে আনছে।

অবশেষে বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা। ওটা আর লিখছি না। কারণ, নাট্যপর্বটি সুখকর ছিল না। যার বাবা যত রাগী তার তত নির্মম অভিজ্ঞতা।

এরপর ট্রেনে চেপেছি বহুবার। এখনও বাড়ির কথা মনে হলে হৃদয় গহীনে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। ওইতো ছোট্ট ফ্রেমের জানালা! কৈশরের অবাক করা চাহনি! সব ভেসে ওঠে মনের পর্দায়।

আমার দৈনিকটির অফিস কমলাপুর রেলস্টেশনের একদম কাছে। টেবিলে তন্ময় হয়ে কাজ করছি। হঠাৎ কোনো অসতর্ক মুহূর্তে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। মনে হয় এক্ষুনি চেপে বসি ট্রেনে। ছুটে চলি বাড়ির দিকে। ইঞ্জিনের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বলি

ঝক্কর ঝক্কর ময়মনসিং – বাড়ি যেতে কতদিন…
=========================
আলোচনা- 'জীবজগতে বেঁচে থাকার কৌশল' by আরিফ হাসান  আলোচনা- 'মিনার : মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন' by শেখ মারুফ সৈকত  আলোচনা- 'ভাষা নিয়ে যত কথা' by আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ  গল্প- 'বোকা জ্যাকের কাণ্ড' অনুবাদঃ জাফর তালুকদার  স্মৃতি ও গল্প- 'চানমিয়ার হাতি দেখা' by ড. কাজী দীন মুহম্মদ  ভ্রমণ- 'সাগরকন্যার তীরে' by এস এম ওমর ফারুক   ইতিহাস- সংবাদপত্রে যেভাবে সংবাদ এলো by জে হুসাইন  ভ্রমণ- 'আমার দেখা নরওয়ে' by অধ্যাপিকা চেমন আরা  রহস্য গল্প- 'আসল খুনি' সৌজন্যে কিশোরকন্ঠ  আলোচনা- 'নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ' by শরীফ আবদুল গোফরান  ফিচার- 'মোরা বড় হতে চাই' by আহসান হাবীব ইমরোজ  ইসলামী গল্প- 'সেনাপতির নির্দেশ' by কায়েস মাহমুদ  ইসলামী গল্প- 'বয়ে যায় নিরন্তর' by কায়েস মাহমুদ


কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ হামিদুল ইসলাম


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.