স্মৃতি ও গল্প- 'চানমিয়ার হাতি দেখা' by ড. কাজী দীন মুহম্মদ

দিন যায়, কথা থাকে। দুঃখের রজনী পোহাতে চায় না। সুখের রজনী মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়।
 
আক্ষেপ থেকে যায়, কেন এত তাড়াতাড়ি রাত পোহাল, কাকেরা কোলাহল শুরু করল।
সময় বড় নিষ্ঠুর। তবে ‘নাই নাই নাই যে সময়, নাই নাই। কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়’।

কথা বলছি আজ থেকে সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের। তখন দিন ছিল শান্তি সুখের। গরিব-ধনী বলে কথা নেই। সবাই মোটামুটি শান্তিতে ছিল। কেউ কারো ব্যাপারে খুব একটা হস্তক্ষেপ করত না। নাক গলাত না। একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ তেমন একটা পোষণ করত না। কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। তবু বলা চলে, আজকের অশান্ত দুনিয়ার হা হা কা কা ছিল না। কাকে মেরে কাকে খাব, কাকে কাত করে কার সর্বনাশ কিভাবে করব এ নিয়ত সমাজের দু-একজনের ছাড়া বেশি ছিল না। অধিকাংশই বলা চলে ছিল শান্তিপ্রিয়। এখনকার মত এমন নিষ্ঠুর সময়, এমন স্বার্থান্ধ কাল, এত নগ্ন পরিব্যপ্তিতে ছিল না। এখনকার দিনে মনে হয় জেদ করে সময়ের নিষ্ঠুরতাকে আঘাত করার জন্যই যেন সব সময় উত্তেজিত, উত্তপ্ত মেজাজ ও নিষ্ঠুর আচরণ, বিনা দ্বিধায় প্রদর্শন করে যাচ্ছি।

সে-কালের সমাজ ছিল গ্রামের পঞ্চায়েত কিংবা দশায়েত শাসিত। তার মধ্যে অবশ্যই পক্ষপাতিত্ব, কায়দা-কৌশল ও হারজিতের ব্যাপার যে ছিল না, এমন নয়। তবে এখনকার মত এত প্রকট ও এত নগ্ন ছিল না। গাঁয়ের মানুষের প্রতি, পাড়ার প্রতিবেশীর প্রতি, ভিন দেশী মুসাফির, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি, এমনকি অনাত্মীয় অপরিচিত অভ্যাগতের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ, একটা দরদ ও সহানুভূতির দৃশ্যমান আবহ সর্বত্র বিরাজ করত। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে সবাই মোটামুটি ভালোবেসে স্নেহ করে, ভক্তি করে, দরদ দিয়ে বুঝত ও দেখত। যে জিনিসটির এখন শতকরা সোয়াশই অনুপস্থিত। তখনকার মানুষ তেমন তথাকথিত শিক্ষিত ছিল না। তাদের জীবন যাপনের মান এখনকার মত অত উন্নতও ছিল না। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলতে পারি, মানবতাবোধের এখনকার মতো এতটা দুর্ভিক্ষ ছিল না। নিতান্ত গরিব মানুষ। দিন আনে, দিন খায়। এতেও কোন অসন্তুষ্টির চিহ্ন নেই। আত্মীয় স্বজন নিকটই হোক আর দৃর সম্পর্কীয় হোক, কিংবা আত্মীয় না-ই হোক, মানুষ হিসেবে সকলের কাছেই তার একটা মর্যাদা ছিল। একজন মুশাফির এলে তার প্রতি নজর দেয়া হতো বিশেষ দৃষ্টিতে। একজন এসে বলল, আপনাদের গ্রামের পাশের গ্রামের মনসুর মিয়ার মায়ের মামুর বাড়ি আমাদের গ্রামে। এতটুকুই যথেষ্ট। সে মুনসুর মিয়াকে হয়ত জানেও না তার মামার বাড়ি? সে তো কোন দিন নামও শোনেনি তবু তার কথায় বিশ্বাস করে তার অসুবিধার কথা চিন্তা করে তাকে আপন মায়ের মামার বাড়ির মানুষ বলেই আদর আপ্যায়ন করা হতো। এতে আয়োজন তেমন ছিল না কিন্তু আন্তরিকতায়, অভাব বোধের শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যেতো।

আমাদের বাড়ির দু’তিন বাড়ি পরে পূর্ব দিকে ফজু নামে একজন আছে। তার শৈশবেই পিতার মৃত্যু হয়। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। ফজু পাশের বাড়ির সদাগর মুন্সীর স্ত্রীর আদর যতেœ বড় হয়ে ওঠে। এখন সে কাজ করে। কিষাণ। সদাগর মুন্সী তার পালক পিতার ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার বাড়ির আঙিনার একধারে গোয়াল ঘরের পাশেই ছোট একটি ছনের দোচালা তুলে থাকতে দিয়েছেন। ফজু বিয়ে শাদি করেছে। দুই সন্তানের জনক সে। কিছুই নেই। এমনকি ভিটা বাড়িও না। তার পরও তার মুখে কোন দিন বিষন্নতার ছাপ দেখা যায়নি। একদিন মাগরিবের সময় ফজুর ছয়-সাত বছর বয়সের মেয়ে রাবিয়া এসে আমার মায়ের কাছে বলছে : ‘বুয়া গো মায় কইছে খড়ম দিতেন।’ মা কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে জানতে চাইলেন : ‘খড়ম দিয়া কী করবি?’ ‘আমাগ বাড়িত একজন মেমান আইছে। তানি বলে অজু করব।’ আমার মা আর বাক্য ব্যয় না করে, আমাদের ব্যবহারের এক জোড়া খড়ম তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘মেমান চইলা গেলে দিয়া যাইছ।’ ‘আচ্ছা’ বলে খড়ম নিয়ে রাবেয়া চলে গেল। সে চলে গেলে, একটি ছোট লোটা আমার হাতে দিয়ে মা বললেন, ‘বাবা তুই যা, এ লোটা নিয়ে রাবেয়ার মায়ের কাছে দিয়ে আয়।’ দুধ। মা নিজেই স্বগত বলতে থাকলেন, ‘তাদের তো গাই বা বকরি কিছুই নেই। দুধ পাইবে কই? তা ছাড়া গরিব মানুষ, মেমানকে খাওয়াইব কী দিয়া?’ তখনকার দিনে পাড়ার মধ্যে একজনের মেহমান এলে সকলেরই মেহমান হিসেবে গণ্য হতো। আর এখন? আপন চাচাত ভাই মামাতো ভাই, অর্থাৎ যে-কোন নিকট-আত্মীয় এলেও, ঘরে বাইরে সর্বত্রই যেন কেমন অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ আবার কী আপদ এলো বলে মনে মনে জ্বালা অনুভব করতে থাকে। তখন আর্থিক দীনটা ছিল; কিন্তু প্রাণের প্রাচুর্য ছিল, স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। সাংসারিক অভাব অনটন আন্তরিকতার কাছে তুচ্ছ হয়ে যেতো। আর আজ আত্মীয়তা সহৃদয়তা সবার ঘর থেকে বিদায় নিয়েছে। তখন লেখাপড়া ছিল না। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল। ছাত্রসংখ্যা বড় জোর দুই কুড়ি। আমাদের বাড়িতেই মসজিদ, সেখানে আমার চাতাতো ভাই ইমামতি করতেন। তাঁর স্ত্রী, আমাদের ভাবী, সকাল বেলা আলিফ-বে-তে-ছে পড়াতেন, নামায দোয়া-কালাম শিখাতেন। ছাত্রী ও ছাত্র মিলিয়ে ছিল সাত আট জন। তাদের পিতামাতার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি চল সই। ছাত্র ও ছাত্রীরা বেতন দিত সম্মানী। আম-কাঁঠালের মওসুমে একটা কাঁঠাল, দশটা আম কিংবা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এক ডালা, পেঁয়াজ বা মরিচ, বরইয়ের দিনে বরই, ডালের দিনে ডাল। এসবের বাহ্য মূল্য যা-ই হোক অন্তরঙ্গতায় সমৃদ্ধ ছিল। বলি হায়রে সে-কাল কই!

কথায় কথা বাড়ে। আমরা আপেচাল পাড়তে পাড়তে আসল কথা থেকে দূরে চলে এসেছি। কিন্তু এ সমাজ-পটভূমি না বলে ইঙ্গিতে বা ইশারায় সব কথা বোঝাতে পারতাম না। তাই, এসব বেহুদা হলেও এক্কেবারে হুদা নয়।

পৌষ মাস। পালক পিতা সদাগর মুন্সী একটি গরু বিক্রি করার জন্য ফজুকে বারদী হাটে পাঠালেন। বারদী তখন সমৃদ্ধ জমিদারদের বসবাস। গরুর হাটও খুব বড়। কাছাকাছি কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ঢাকার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীÑ এসব এলাকা থেকে প্রচুর গরু ও বকরি আমদানি ও বেচাকেনা হতো সেই হাটে। যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, নোয়াখালী এমনকি চট্টগ্রাম থেকে পাইকাররা গরু কিনার জন্য ভিড় জমাতো বারদী হাটে। সদাগর মুন্সী আনুমানিক একটি মূল্য বলে দিয়ে এর কাছাকাছি মূল্যে গরুটি বিক্রি করার অনুমতি দিয়ে দিলেন। ফজু কথামতই দাম পেয়ে গেল এবং গরু বিক্রি করে ফেলল। গরু বিক্রি তো একটি ব্যবসা। ফজুর গরু বিক্রির বাণিজ্য শেষে আরো একটি উপরি ব্যবসা হলো। বারদীর অদূরে আড়াইহাজার থানার নানাহি গ্রামের এক দরিদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়; পরিচয় অবশেষে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। বিদায়ের সময় উভয়ে উভয়কে দাওয়াত দিল। কোন দিন যেন সময় করে বেড়াতে যায়। বাড়ি ফিরে এলে তার এ উপরি পাওনা অর্থাৎ নতুন দোস্তির কথা অনেকের কাছে বলে আনন্দ পেল।

দিন চলে যায়। দেখতে দেখতে রমাদান অর্থাৎ রোজার মাস চলে এলো। রোজা শুরু হওয়ার মাসখানেক বাকি থাকতেই যাঁদের সঙ্গতি আছে, তারা গরু খাসি ইত্যাদি কোরবানির পশু কিনে রাখেন। যিনি পারেন পালের গরু-খাসি ইত্যাদি কোরবানি দেন। ফজুর পালক পিতা সদাগর মুন্সী নিজের পালের গরুই কোরবানি দিতেন। আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের (বর্তমান ইউনিয়ন কাউন্সিল) চেয়ারম্যান সাহেব ভারতের বিহার প্রদেশের হরিছত্র মেলা থেকে একটি বেশ বড় গরু কিনে আনিয়েছেন। গাঁয়ের লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, এটাতো গরু না, আত্তি (হাতি)! চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে, প্রেসিডেন্ট সাহেব একটি হাতির মত গরু কিনেছেন কোরবানির জন্য। কাছাকাছি কয়েক গ্রামের লোকেরা গরু দেখার জন্য ভিড় করতে লাগল। প্রত্যেক দিন বহুলোক, এমনকি মেয়েরাও আত্তিটিকে একনজর দেখার জন্য এসে হাজির হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি একটি তামাশা মনে করে সারাদিন নিজেদের বন্ধুবান্ধবী নিয়ে এসে বহুক্ষণ দেখে আনন্দ উপভোগ করে।

ফজুর মেয়ে রাবিয়ার দেখা হলো না, এমন একটা অদ্ভুত জানোয়ারÑ যার কথা সে কেবল শুনেই যাচ্ছে। কারণ যেদিন গরুটি আনা হয়েছে তার পরের দিন থেকেই তার জ্বর। প্রথমে দুই দিন সামান্য ছিল কিন্তু পরে প্রবল জ্বরে কাতর ও দুর্বল হয়ে পড়ে চটপটে রাবেয়া। তার বড় ইচ্ছা গরুটি দেখার। কিন্তু মা বাধা দিচ্ছেন। আগে জ্বর সারুক তারপর যাবি গরু দেখতে। জ্বর সারতে সারতে ছয়-সাত দিন লেগে গেল। রাবেয়ার আর ধৈর্য নেই। তার সঙ্গে তার ভাই চান মিয়ারও। চান মিয়াও বলে মা আমি আত্তি দেখমু। মা বলে, দেখাব মঙ্গলবার! ফজুর তো সময় হয় না। সারাদিন অন্যের কাজ করে বিকেলে ফিরে এসে আর কিছু করতে মন চায় না। ছেলেমেয়ের আবদারে সে তার বউকে হুকুম দিল। তুমিই একবার গিয়ে দেখাইয়া আন। চান্দুরে কোলে নিও আর রাবেয়ার হাত ধইরা রাইখো। খবরদার কাছে যাইও না। কাল তো সোমবার হাটের দিন। এমনিতেই লোকের ভিড় হবে। পরশু দিন নাস্তার পরে যাওয়া যাবে। অধীর আগ্রহে রাবেয়া ও চানমিয়া ওরফে চান্দু অপেক্ষা করে। অবশেষে পরশু অর্থাৎ মঙ্গলবার এলো। আজ ভোর না হতেই উঠে বসে আছে দুই ভাইবোন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ ভিড় করে থাকে। আজো তাই। কাছে না গেলে ভিড়ের কারণে দেখাও যাবে না। তাই কোন মতে ঠেলাঠেলি করে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রাবেয়ার মা। চান্দু তার কোলে আর রাবেয়ার হাতে ধরা। তারা দাঁড়াতেই দুইজন কাজের লোক গরুটাকে নদীর পাড়ে গা-ধোয়ানোর জন্য নিয়ে যেতে এলো। যেহেতু বন্ধন খোলা হবে তাই সবাই একটু সরে দাঁড়ালো। কাছ গিয়ে কাজের লোকেরা হাতিটির গায়ে হাত দিয়ে গলায় আদর করে সোহাগ করতে লাগলো। এতে হাতি খুশি হয়েছে, না বেজার বোঝা গেল না। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণও আছে। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে এসেছে। এখানকার পরিবেশও নতুন, মানুষজনও অপরিচিত। ভাষাও বুঝা যায় না। ষাঁড়টির পক্ষে এত কিছু মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। তার উপর হরিছত্র মেলা থেকে এখান পর্যন্ত ভ্রমণের কষ্ট। কয়েক শ’ মাইল তো হবেই। তা ছাড়া মেলায় আসতে কতখানি হাঁটতে হয়েছে তাও তো কম হবে না। এসব ধকল সহ্য করে এখানকার খাওয়া খাদ্যও তার মনমেজাজ মতো কি না, তাই বা কে জানে? হোক না পশু! তারও তো বোধ আছে, অনুভূতি আছে। যারা একে নিয়ে এসেছে তারাও সব সময় কাছে থাকে না। গরুর মালিক তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী খায়, কী পছন্দ করে, কী খায় না, কী অপছন্দ করেÑ এসব কথা। যারা এর পালনের দায়িত্ব নিয়েছে, তারা সাধ্যমত চেষ্টা করে, তাকে খুশি করতে। এখানে এসেছে দশ বার দিন হয়। এর মধ্যে সকল কিছুর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। শ্বশুর বাড়ির এত আদর যতœ সত্ত্বেও তার ভালো লাগছে কি না কে জানে?

গরুটির গলার দড়ির সঙ্গে ডানে ও বাঁয়েÑ দু’দিকে শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে দু’টি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। দু’জনে দু’টি বন্ধন খুলে দু’পাশ থেকে সাবধানে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন ফাঁসির হুকুমপ্রাপ্ত কয়েদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। হঠাৎ কী জানি কী মনে করে দু’জনের মধ্যে একজনের দিকে গরুটা গুঁতা দেয়ার জন্য উদ্যত হলো। আর অমনি ভয়ে তার হাত থেকে দড়িটা ছুটে গেল। আর যায় কোথায়? এক মুহূর্তে দ্বিতীয় জনকে আক্রমণ করতেই ছেড়ে দিয়ে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল। গরুটি ছাড়া পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে ডান দিকের খোলা মাঠের দিকে দিল দৌড়। দর্শনার্থী যারা ভিড় করছিল তাদের মধ্যে লেগে গেল গোলক ধাঁধা। তারাও গরুটির মতই প্রাণভয়ে হুড়মুড় করে পড়ি কি মরি অবস্থায় ছুটাছুটি করে যে যার সুবিধামতো বাঁচার চেষ্টা করল। ছোটরা সবাইতো আর প্রস্তুত ছিল না। তাই কেউ কেউ দৌড় দিল, কেউ ব্যথা পেল, কেউ পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ধাক্কাধাক্কি করে কে কার গায়ে পড়ে তার দিশা নেই। চারদিকে হইচই কান্নাকাটি-চিৎকারের রোল পড়ে গেল। চিৎকার ও গণ্ডগোল শুনে পাড়ার জোয়ানরা দৌড়ে এসে কেউ কিছু বুঝল, কেউ কিছু না বুঝেই ছোটাছুটি করতে লাগল। গরুর পেছনে ছুটল একদল দর্শকদের কেউ দৌড়ে পালাল, কেউ আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। চারদিকে হায় হায় রব। আমাদের রাবেয়ার মা? অপ্রস্তুত অবস্থায় দৌড় দিতে গিয়ে নিজের কাপড়ের সঙ্গে প্যাঁচ লেগে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাবেয়া হাত থেকে ফসকে কোথায় গেছে ঠিক নেই। কোলের চান মিয়াও কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে চিৎকার শুরু করেছে। ইত্যবসরে চিৎকার ও হৈহুল্লা শুনে ফজুও ক্ষেতের কাজ ফেলে দৌড়ে এসেছে। এসে বউকে দেখ শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সে কোমরে ব্যথা পেয়েছে। ছোট বাচ্চাটাকে কেউ একজন ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। এ দিকে রাবেয়ার খোঁজ নেই। ছুটাছুটির সময় অন্য একজনের হাত ধরে কিছু দূর গিয়ে আর এগুতে পারেনি। সেখানে বসেই কাঁদছে। সে এমনিতে দুর্বল। কয়েকদিনের জ্বরের ধকল এখনো যায়নি। তার ওপর যার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, পথে হোঁচট খেয়ে তার হাত থেকে ফসকে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর ফজু তাকে পেয়েছে। কপাল ফুলে গেছে। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে কপালেই ব্যথা পেয়েছে।

যাক, তিনজনকে খুঁজে পেয়ে ফজু আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছে। বাড়ি এসে তিনজনই শয্যাশায়ী। ফজুর বউয়ের কোমরে ব্যথা, রাবেয়ার মাথার সামনে ফুলে গেছে এবং প্রচণ্ড ব্যথায় অস্থির। আর চান মিয়া দেহের কোথায় ব্যথা পেয়েছে বলতে পারছে না কিন্তু অসহ্য ব্যথায় তার কান্না আর থামছে না। তিন জনেরই প্রবল জ্বর। ফজু একাই তাদের সেবায় লেগে গেছে। তার পালক মাতা, সদাগর মুন্সীর স্ত্রী মাঝে মধ্যে এসে মাথা ধোয়ানো, কিছু রান্না করে এনে খাওয়ানোÑ এসব করেন।

তিন চার দিনের মধ্যে রাবেয়ার মা ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠেছে। রাবেয়ারও জ্বর কমেছে। কিন্তু চান মিয়ার জ্বর আর কমে না। থেকে থেকে কেবল প্রলাপ বকে। সে ভয় পেয়েছে। আঘাতের চাইতে আতঙ্কই তাকে কাবু করে ফেলেছে। দক্ষিণ পাড়ার মিয়া সাবের পানিপড়া আর করিম মুন্সীর ঝাড়া, দোয়া দরুদেও কোন কাজ হলো না। দিন দিন তার জ্বর আর প্রলাপ বেড়েই চলছে। অবশেষে পনের দিন প্রবল জ্বরে ভুগে চান মিয়া তার মা-বাবা আর বোনকে কান্দিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। আজও মঙ্গলবার চান মিয়া জ্বরের ঘোরে বকতো, মা মঙ্গলবার হাতি দেখমু।

চান মিয়ার বাপ ফজুর আগের সে হাসিখুশি চেহারা আর নেই। সে একা একাই প্রলাপ বকে আর কান্দে। বলে পোলাডার একটা লাল জামার বড় আউস ছিল। এবার ঈদের সময় কিনে দিমু বলেছিলাম। সে কথা মনে করে আর নিজে নিজেই কিসব বলতে থাকে।

আর তার বউয়ের কান্নারও শেষ নেই। একা একা চোখের পানি মোছে আর গুনগুনিয়ে গায়, কান্দে, কান্দের দেওয়ান কুটুর মিয়ার মায়। যে শোনে তারও কান্না পায় চান্দুর মায়ের কান্নায়।

পাড়ার সবাই ফজু ও তার পরিবারের জন্য কষ্ট পেয়েছে। সবাই সমবেদনা দেখাচ্ছে। কিন্তু মনতো বুঝ মানে না। পুত্রশোকে ফজু আর ফজুর স্ত্রীর কান্নায় গাছের পাতা ঝরে পড়ে। আসমানের তারা কান্না শিশির হয়ে ঝরে। সকালে দোয়েল পাখিটা এসে হায় কপাল! চান্দু কই বলে কান্নার শিশ দিয়ে যায় পেয়ারা গাছটায় বসে। এখানেই তো চান মিয়া খেলা করতো!
==========================
ভ্রমণ- 'সাগরকন্যার তীরে' by এস এম ওমর ফারুক ইতিহাস- সংবাদপত্রে যেভাবে সংবাদ এলো by জে হুসাইন  ভ্রমণ- 'আমার দেখা নরওয়ে' by অধ্যাপিকা চেমন আরা  রহস্য গল্প- 'আসল খুনি' সৌজন্যে কিশোরকন্ঠ  আলোচনা- 'নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ' by শরীফ আবদুল গোফরান  ফিচার- 'মোরা বড় হতে চাই' by আহসান হাবীব ইমরোজ  ইসলামী গল্প- 'সেনাপতির নির্দেশ' by কায়েস মাহমুদ  ইসলামী গল্প- 'বয়ে যায় নিরন্তর' by কায়েস মাহমুদ  ইসলামী গল্প- 'ভালোবাসার বিশাল' by আকাশ কায়েস মাহমুদ  গল্প- 'একজন ভোলা চাচা' by দিলারা মেসবাহ  গল্প- 'বীথির ভাবনা' by হেলাল আরিফীন গল্প- 'স্বপ্ন' by তাওহীদুর রহমান গল্প- 'আবিরের মাধবী লতা' by নিয়াজুল হাসান জুয়েল মোল্লা  ফিচার- 'ঝাড়ুদার মাছ' by আরিফ হাসান  গল্প- 'এগিয়ে যাবার স্বপ্ন' by মাহফুজা জাহান তাকিয়া  গল্প- 'লাল ফ্রক' by আবু রায়হান মিকাঈল  প্রবন্ধ- ‘আর নয় শিশুশ্রম' by জাকারিয়া হাবিব পাইলট  কিশোর ফিচার- 'আমার ঘুড়ি আকাশ জুড়ি' by মাসুম কবির কিশোর ফিচার- 'চাই চীনাবাদাম' by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. কাজী দীন মুহম্মদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.