পতিসরের রবীন্দ্র স্মৃতি-নিদর্শন -সংরক্ষণ by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববঙ্গের জমিদারি পতিসর থেকে সমপ্রতি পাওয়া কবির স্বহস্তে লিখিত পত্রখানি সেখানেই সংরক্ষণ করতে চায় এলাকাবাসী। পত্রখানি পাওয়া গেছে কবির পতিসরের মুসলমান পাচক মৃত কবেজ আলি মণ্ডলের বাড়িতে রক্ষিত পুরোনো কাগজপত্রের পুঁটুলি থেকে। এখন থেকে ১১৩ বছর আগে, ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র তারিখে ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী কবি এই দীর্ঘ চিঠিখানি লিখেছিলেন বোলপুর থেকে। কবির স্মৃতি রোমন্থনের নানা তথ্য আছে এতে। তবে কাকে কবি চিঠিখানি লিখেছিলেন তা ঠিক বোঝা যায় না। চিঠিখানি উদ্ধার করেছেন রবীন্দ্রপ্রেমী যুবক মতিউর রহমান মামুন। মতিউর রহমান মামুন সন্ধান পেয়েছেন আরেক দুর্লভ সংগ্রহের—কবির পতিসর ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ ও পতিসর জমিদারির আয়-ব্যয়ের খরচের খাতা। শেষোক্তটি রক্ষিত আছে পতিসরের সন্নিকটবর্তী রানীনগর উপজেলার বিলকৃষ্ণপুর গ্রামের জনৈক কলেজশিক্ষকের কাছে।
রবীন্দ্রনাথের চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে গেছেন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা এসে—তাঁরা সেটি সংরক্ষণ করবেন তাঁদের জাদুঘরে। হিসাবের খাতাটিও চলে যাবে জাতীয় জাদুঘরে, ঢাকায়। এলাকাবাসী পতিসরের কাচারিবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরে’ তা রাখতে চায়। ২০০৮ সালে এখানকার এই জাদুঘরের দ্বারোদ্ঘাটন করেছেন নওগাঁর জেলা প্রশাসক। এই জাদুঘরে পতিসরে কবির স্মৃতিবিজড়িত অনেক নিদর্শনসামগ্রীই রয়েছে—পালঙ্ক, আলমারি, ঘড়ি, আরাম চেয়ার, বাথটাব, লোহার সিন্দুক, পতিসরে ব্যবহূত কবির নাগর বোটের দরজা, আয়না ইত্যাদি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থানীয় চাষিদের নিয়ে যে কলের লাঙল দিয়ে জমিচাষ করতেন, তাও এনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এই জাদুঘরে।
পতিসরের এই জাদুঘর আদতে স্মৃতি জাদুঘর। সারা পৃথিবীতেই ‘পারসোনালিয়া’ বা ‘মেমোরিয়াল মিউজিয়ম’ নামে এ ধরনের জাদুঘর রয়েছে। প্রখ্যাত মনীষীদের ব্যবহূত নিদর্শন দিয়েই এ ধরনের জাদুঘর গড়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আছে, দিল্লিতে ‘নেহরু জাদুঘর’, কলিকাতার জোড়াসাঁকোতে ‘রবীন্দ্র জাদুঘর’ শান্তিনিকেতনে ‘রবীন্দ্রভবন’ ইত্যাদি। আমাদের দেশেও প্রায় দুই ডজন এ ধরনের জাদুঘর বা সংগ্রহশালা আছে।
ঢাকায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’, সিলেটে জেনারেল ওসমানি স্মৃতি জাদুঘর, সুনামগঞ্জে হাসন রাজা জাদুঘর, শাহজাদপুরে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি মিউজিয়াম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্মৃতি জাদুঘর। পতিসরের বাসিন্দারা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক ঋণী। কবির স্মৃতিনিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে সেই অপরিশোধ্য তাঁরা খানিকটা হলেও শোধ করতে চান। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই আবেদনের পেছনে অবশ্য যুক্তি আছে।
কবি-পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবদ্দশায়ই একান্নবর্তী পরিবারের ভাগ-বাটোয়ারা করে দেন। জমিদারি ভাগ হওয়ার আগে পূর্ববঙ্গের তিনটি জমিদারি—কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর এবং রাজশাহীর কালিগ্রাম পরগনা রবীন্দ্রনাথই দেখাশোনা করতেন। জমিদারি ভাগ হওয়ার পর কালিগ্রাম পরগনা হয় রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি। কালিগ্রাম পরগনার সদর এই পতিসর। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কবির যোগাযোগ ছিল পতিসরের সঙ্গে। পূর্ববঙ্গের অন্য অঞ্চল থেকে এখানকার প্রকৃতি যেন বেশ খানিকটা আলাদা—ধূসর, উদাস। পতিসরে লেখা কবির কবিতা, গান, ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং স্বজনদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে এই স্বতন্ত্র প্রকৃতির আভাস মেলে। প্রজা হিতার্থে কবি এখানে গ্রামোন্নয়নমূলক বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল প্রজাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ, চিকিত্সা বিধান, জলকষ্ট সমস্যার সমাধান, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত, সুষ্ঠু বিচার—সালিসি-ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে তাঁর গ্রামোন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন কয়েকজন দক্ষ সমাজকর্মীর দ্বারা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য—কালিমোহন ঘোষ, অতুল সেন, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’খ্যাত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পুঠিয়ার রাজ-এস্টেটের দেওয়ান প্রসন্নকুমার মজুমদারের পুত্র শৈলেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। এখানকার কৃষির উন্নতির জন্যই পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষ্টিতে স্নাতক করে এনেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ পতিসরের চাষিদের সঙ্গে নিজেই যে কলের লাঙল চালিয়েছেন তা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯০৫ সালে কবি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’। কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল অধিক মুনাফালোভী মহাজনদের হাত থেকে গরিব চাষিদের রক্ষা করা। চাষিদের অল্প সুদে ঋণ দিতেই বন্ধুদের আর্থিক সহায়তায় এই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করেন। পরে অবশ্য কবি নোবেল পুরস্কারের অর্থের বড় একটি অংশ এই ব্যাংকে জমা রাখেন। প্রায় ২০ বছর ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ কার্যকর ছিল। কবি পতিসর কাচারির পূর্ব পাশের খোলা জায়গায় রেশম কারখানা প্রতিষ্ঠা করে রেশম বস্ত্র বয়নের প্রকল্পও চালু করেন। প্রজাদের নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে রাতোয়াল, কামতা ও পতিসরে মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় (১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই পতিসরে শেষ যাত্রার কবি শেষোক্ত মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়টি ‘রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন’ নাম দিয়ে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন) এবং বেশ কটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, পতিসর কামতা ও রাতোয়ালে তিনি দাতব্য চিকিত্সালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানকার প্রজাদের যে তিনি কত ভালোবাসতেন, তা পতিসরের জনৈক গ্রাম-কর্মীকে লেখা চিঠি থেকেই বোঝা যায়: ‘আমাদের গ্রামের জীবনযাত্রা বড়ই নিরানন্দ হইয়া পড়িয়াছে। প্রাণের শুষ্কতা দূর করা চাই। হিতানুষ্ঠানগুলোকে যথাসম্ভব উত্সবে পরিণত করিতে চেষ্টা করিয়ো।’
পতিসরের বাসিন্দারা তাঁদের প্রিয় কবির এখানকার কোনো স্মৃতিচিহ্নই হারিয়ে যেতে দেবেন না। এখানে যেসব স্মৃতি-নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা তাঁরা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে চান—কবির অমর স্মৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই। তাঁদের এই উদ্যোগ বা আকাঙ্ক্ষা আদৌ অযৌক্তিক নয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর চশমা, সিলেটের নূর মঞ্জিলে প্রদর্শিত জেনারেল ওসমানির বেতের লাঠি, সুনামগঞ্জের হাসন রাজা জাদুঘরে উপস্থাপিত হাসন রাজার আলখাল্লা কিংবা শাহজাদপুর রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরে রক্ষিত পিয়ানো যতটা আবেদন সৃষ্টি করে আছে; তা স্থানান্তর করে যত বড় জাদুঘরেই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, তার মর্যাদা হ্রাস পাবে।
পতিসরে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনগুলো পতিসরের জাদুঘরেই সংরক্ষণের ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে অবশ্যই তা হতে হবে সর্বসাধারণের প্রদর্শন উপযোগী, নিশ্চিত করতে হবে প্রদর্শনী সামগ্রীর সুষ্ঠু নিরাপত্তাব্যবস্থায়।
সাইফুদ্দীন চৌধুরী: অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.