সীতাকুণ্ডে সাংসদপুত্রদের কাণ্ড -ঘরের শত্রু বিভীষণদের ঠেকান

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা উপকূলীয় এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতে সাংসদপুত্রদের দখল অভিযানের খবর আরও একটি অশনিসংকেত। সাংসদপুত্র বা শাসক দল আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান হারে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও অবৈধ দখলের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে। এ সবই অস্বস্তিকর ও উদ্বেগজনক। কিন্তু এর চেয়েও যা বেশি উত্কণ্ঠা ও পীড়াদায়ক, তা হলো এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগগুলো যথেষ্ট আন্তরিকতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মোকাবিলা করা হচ্ছে না। সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাবার্তা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু সে সবই বড় বেশি বেসুরো ও অপাঙেক্তয় ঠেকছে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অতীত শাসনামলে ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে যে সাংসদপুত্র বা দলীয় প্রভাবশালীদের স্বজনেরা একধরনের সামাজিক সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এবং তা প্রায় সব ক্ষেত্রে পুলিশের নাকের ডগায়, কখনো বা তাঁদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত হয়ে থাকে। গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আলোকচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, সাংসদ আবুল কালাম মাস্টারের পুত্রদের লেলিয়ে দেওয়া লোকজনের দখল-অভিযানকালে অস্ত্রধারী পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। এ খবর ও ছবি জনমনে সন্দেহাতীতভাবে এ ধারণা গেঁথে দিচ্ছে যে দেশে আইনের শাসন নেই; চলছে অন্যায় ও অবিচার। পুলিশ জনগণ কিংবা আইনের বন্ধু নয়। তারা ক্ষমতাসীনদের মোসাহেবি করে। অপ্রিয় হলেও অস্বীকার করা যাবে না যে এ ধরনের অনাচারই এক-এগারোয় শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পটভূমি তৈরিতে মদদ জুগিয়েছিল। সুতরাং সীতাকুণ্ডের মতো দখলদারির ঘটনাবলি আমাদের জোট সরকার আমলের দুঃসহ ভূমিদস্যুতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব আমরা দেখি আর প্রমাদ গুনি। বিএনপির সাংসদপুত্রদের জুলুম সংবাদপত্রে ছাপা হলেও তা সুফল দেয়নি।
সাংসদ আবুল কাশেমের জ্যেষ্ঠ পুত্র মামুনের অপরাধবৃত্তি আকস্মিক নয়। আওয়ামী লীগ শাসনের ১৯৯৬—২০০০ পর্বে মামুনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছিল। তখনই যদি তাঁকে শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো আজ মামুন তাঁর ছোট ভাই নোমানকে নিয়ে শিপইয়ার্ড দখলে বেপরোয়া হতেন না; সাংবাদিক নিগ্রহে সাহস পেতেন না। মামুন-নোমানরা সামাজিক সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে এখন সামাজিক বোঝা হয়ে উঠেছে। এর দায় আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে না। গত ২২ জানুয়ারি মামুন তাঁর ইয়ার্ডে জাহাজ ভেড়ানোর স্বার্থে বৃক্ষনিধনে নেতৃত্ব দেন। সীতাকুণ্ড থানা তাঁর নামে মামলা নেয়নি। এরপর বন বিভাগ আদালতে করা মামলায় তাঁকে আসামি করে। তদন্ত রিপোর্টে তাঁর নাম বাদ পড়ে। বন বিভাগ তাই নারাজি দেয়; কিন্তু আদালতে তা অগ্রাহ্য হয়।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড বা জাহাজ ভাঙার মাঠ নিয়ে সীতাকুণ্ডে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। সবুজ বেষ্টনী ও উপকূলীয় বেড়িবাঁধের নিরাপত্তার স্বার্থে জমি ইজারা বন্ধ থাকা দরকার। পাঁচটি ইজারার সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছে বেলা। উচ্চ আদালত তা স্থগিত করলেও নতুন ইজারা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। বন উজাড়ও চলছে। বন বিভাগের করা ১২টি মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মূলত ওই সাংসদের আশীর্বাদপুষ্ট বলেই অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের সরকারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র চলছে। তারা এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। আমরা তা জানার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে সীতাকুণ্ডের মতো ঘটনাবলি প্রতিকারহীনভাবে বাড়তে থাকলে সরকারের অস্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্যহীন হয়ে পড়া কোনো নেতা-নেত্রী ভাষণ দিয়ে কিংবা ভর্ত্সনা করে ঠেকাতে পারবেন না। বিভীষণদের আগে ঠেকান।

No comments

Powered by Blogger.