প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি -অনেক সুচিন্তার সমাবেশ ঘটেছে by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাসংস্কার, শিক্ষানীতি—এর প্রতিটি একটি পৃথক ধারণা। তবে এরা গভীরভাবে পরস্পর সম্পর্কিত। যে দলিলটি দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রকাশ করেছে, তাতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯’ নামকরণটি যথার্থ হয়েছে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে সংস্কারমূলক আলোচনা-পর্যালোচনা একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া। এই অব্যাহত প্রক্রিয়ার বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত হয়ে দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে আশু কর্তব্যগুলো চিহ্নিত করা ও সরকারকে সেইভাবে পরামর্শ দেওয়া, যার ভিত্তিতে সরকার তার শিক্ষাবিষয়ক কর্তব্য স্থির করবে। জাতীয় শিক্ষানীতি বলতে এই বোঝায়। ওই উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটি তার কাজ শেষ করেছে। প্রস্তাবটি খসড়া আকারে এখন সবার সামনে আছে। ওয়েবসাইট থেকে খসড়াটি যে কেউ উদ্ধার করতে পারে ও তার মতামত জানাতে পারে। এই সুযোগ গ্রহণ করে ইতিমধ্যে একাধিক গোলটেবিল হয়ে গেছে। একাধিক লেখা বেরিয়েছে সংবাদপত্রে।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি কোন বিষয়গুলো শনাক্ত করেছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে? আমার বিবেচনায়—এক. প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি বিস্তৃত করে একে আট বছর মেয়াদি কার্যক্রমে উন্নীত করা এবং এর আওতায় দেশের ৫ থেকে ১৩ বছর বয়স্ক সবাইকে যুক্ত করা। এই প্রস্তাবের গুরুত্ব, এর বাস্তবায়নের জটিলতা ও বিশালতা বোঝার জন্য এর সঙ্গে যুক্ত অর্থায়নের প্রস্তাব, তা দুটি বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে—হ্যাঁ-বাচক ও না-বাচক। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। সরকার কীভাবে নেবে এই দুরূহ ও দুঃসাধ্য প্রস্তাবকে, জানি না; তবে জানতে বেশি দিন লাগবে না।
দুই. প্রস্তাবটির সফল বাস্তবায়নে যে বাধাটি, শুরুতেই তা দূর করতে হবে; তা হলো ঝরে পড়ার হার। প্রাথমিক শিক্ষার পঞ্চম শ্রেণীতে পৌঁছার আগেই অর্ধেক ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছার আগে আরও অনেকে। কারণ দারিদ্র্য এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ। সর্বজনীন সাক্ষরতা অর্জন সম্ভব হবে না, যদ্দিন না এই দুস্তর বাধা আমরা অতিক্রম করছি। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে কমিটি এবং দুপুরবেলা ক্ষুধার্ত শিক্ষার্থীর ক্ষুন্নিবৃত্তির সাহসী প্রস্তাবও করেছে।
তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে এই শিক্ষানীতির খসড়ায় তা হলো, তথ্যপ্রযুক্তি আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থায় কম্পিউটার-সাক্ষরতার উপযোগিতা শুধু নয়, এর আবশ্যকতাকে তুলে ধরা হয়েছে খসড়া শিক্ষানীতির মধ্যে।
চতুর্থ যে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা হলো, ভোকেশনাল শিক্ষা, এর পরিসর বৃদ্ধি এবং শিক্ষার অষ্টম থেকে দ্বাদশ বছর পর্যন্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করে জাতীয় দক্ষতামান ১ থেকে ৪ পর্যন্ত অর্জনের পথ করে দেওয়া। এর পর ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হবে সবার জন্য। এযাবত্ উচ্চপর্যায়ের কারিগরি শিক্ষায় উচ্চবর্ণীয় সংস্কার আধিপত্য বজায় রেখেছে, এমনকি ডিপ্লোমাধারীরাও কারিগরি শিক্ষার উঁচু মহলে প্রবেশাধিকার পায়নি। শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে কারিগরি শিক্ষার জায়গাটা বড় করে দিয়ে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পরিসর বৃদ্ধি যে খুবই সময়োপযোগী চিন্তা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
শিক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন প্রস্তাব করা যত সহজ, বাস্তবায়ন ততই কঠিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে একটি প্রচলিত কাঠামোর ভিত্তিতে। এভাবেই দেশের পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আট (তৃতীয়-দশম শ্রেণী) বছর মেয়াদি উচ্চবিদ্যালয়, চার বছর মেয়াদি ডিগ্রি কলেজগুলো গড়ে উঠেছে। শরীফ কমিশনের (১৯৫৯) সুপারিশে ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক অংশ (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী) নিযুক্ত করার বাস্তবায়ন সহজ হয়নি। এখন যে স্তরকে আমরা উচ্চমাধ্যমিক বলছি, দীর্ঘকাল তার পরিচয় ছিল ইন্টারমিডিয়েট, মধ্যবর্তী, না-মাধ্যমিক, না-উচ্চ। স্তরটিকে দেখা হয়েছিল উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে। সে জন্য এর জায়গাও স্থির হয়েছিল ডিগ্রি কলেজের অঙ্গনে। ডিগ্রি কলেজের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলী এই স্তরের শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা তুলনামূলকভাবে নিম্নস্তরের শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত আছেন, কখনো মনে করেননি। এই মধ্যস্তর যে আসলে মাধ্যমিক স্তরেরই অংশ, দিন দিন এই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়েছে। একদিকে ডিগ্রি কলেজ থেকে এই অংশটি ছেঁটে ফেলার কথা উঠেছে; অন্যদিকে বিদ্যমান উচ্চবিদ্যালয়কে উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই চিন্তার ফল হিসেবে আমরা ক্যাডেট কলেজগুলো পেয়েছি। যার কার্যপরিধি বিস্তৃত সপ্তম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির আওতায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পুনর্বিন্যাসে প্রথম সমস্যা হবে, পুরোনো ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা স্কুলগুলোর ওপর এর প্রভাব। শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সরকারিভাবে হুকুম জারি করে উচ্চবিদ্যালয়গুলো থেকে তৃতীয়-অষ্টম শ্রেণী ছেঁটে ফেলা যাবে না, উচিতও হবে না। সব উচ্চবিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী খোলাও সহজ হবে না। অসম্ভব হবে বলছি না। এখন যে প্রতিষ্ঠানে যে স্তরের শিক্ষাদান চালু রয়েছে, সেটা বজায় রেখেই প্রস্তাবিত আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক ও চার বছর মেয়াদি মাধ্যমিক শিক্ষাদান ও গ্রহণ সম্ভব বলে মনে করি।
শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিষয়ে অস্পষ্টতার অবসান ঘটেছে বলে মনে হয় না। যেমন, কোন স্তর থেকে ইংরেজি শিক্ষা শুরু হবে। প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম শ্রেণী থেকে ইংরেজিকে আবশ্যিক বিষয় দেখানো হয়েছে। এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। আমার মতে, অগ্রহণযোগ্য, সাধ্যাতীত ও অপ্রয়োজনীয়। এমনকি আত্মঘাতীও।
বাংলাদেশ স্টাডিজ/সামাজিক বিজ্ঞান—সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। যে ক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞান শব্দটি চালু রয়েছে, কেন বাংলাদেশ স্টাডিজ (Bangladesh studies) নামে একটি প্রশ্নবোধক শব্দের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ল। আর পড়লই যদি, একটি উপযুক্ত বাংলা শব্দ দিয়ে একে চিহ্নিত করা যেত না? বাংলাদেশ-পরিচিতি? সামাজিক বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে ‘বাংলাদেশ পরিচিতি’র অবস্থান ভাবা যায়, বিকল্প হিসেবে নয়। কারণ সামাজিক বিজ্ঞান একটি বৃহত্তর পরিসরের ইঙ্গিত।
যা হোক, প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম কাঠামোকে আমরা ‘প্রস্তাবিত’ বলেই মনে করব। কুদরাত-এ-খুদা কমিশন তার বিস্তারিত প্রতিবেদনে শিক্ষাক্রম কাঠামো দেয়নি। এ জন্য তারা একটি পরবর্তী কার্যক্রম প্রস্তাব করেছিল, বিস্তারিত প্রস্তাব তৈরি করবে একটি স্বতন্ত্র কারিকুলাম কমিটি। ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় কারিকুলাম কমিটি সাত খণ্ডে সেই কাজটিই সম্পন্ন করেছিল। ১৪০০ মার্কের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা গুরুভার হবে এই স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য। এটা কোনোমতেই ১২০০ মার্কের বেশি হওয়া উচিত হবে না। আশা করি প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম কাঠামোকে স্পষ্টতা ও গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে সরকার এরপর একটি কারিকুলাম কমিটি গঠন করবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণীর বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে সব ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক বিষয় পড়ানোর প্রস্তাব এই শিক্ষানীতির একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব মনে করব আমরা। মাদ্রাসা ধারার শিক্ষাকে দেশের মূলধারার শিক্ষার নিকটবর্তী অবস্থানে নিয়ে আসার সুফল ভোগ করবে যারা ভবিষ্যতে মাদ্রাসা ধারায় শিক্ষা লাভ করবে, তারাই।
আরও একটি প্রস্তাব আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, গ্রন্থাগারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এই শিক্ষানীতি প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে, সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার গঠন ও উন্নয়নের কথা বলেছে। যত দিন না সব বিদ্যালয়ে উপযুক্ত মানের গ্রন্থাগার গড়ে উঠছে, থানা পর্যায়ে একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সে অভাব পূরণ করবে—একটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী প্রস্তাব। এ ছাড়া প্রত্যেক নগরে, সাধারণ নাগরিকের প্রয়োজন মেটাতে, গ্রন্থাগার গঠন ও পরিচালনা যে পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে এই প্রতিবেদন।
অল্পকথায় বলতে চাই, অনেক সুচিন্তার সমাবেশ ঘটেছে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির খসড়ায়, এর মূল সুর হচ্ছে—শিক্ষা বিষয়ে একটি প্রবল আশাবাদ। এই আশাবাদের উত্স হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একটি বিপুলভাবে জনসমর্থিত সরকারের উপস্থিতি। সরকারই সব আশাবাদের জন্ম দিয়েছে। এবং সেটাই সংক্রমিত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর পাতায় পাতায়। শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির অশুভ প্রভাবমুক্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, তবে এই অভিপ্রায়ের মর্যাদা দেওয়ার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। এ প্রসঙ্গেও সরকারের প্রতিজ্ঞা আছে দলের নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু সরকার গঠনের পর এই প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এ জন্য মন থেকে সব দুশ্চিন্তা দূর হচ্ছে না। সবাই মুখে বলছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পরিবর্তন চাই, কিন্তু দলীয়করণের অভ্যাস এত দৃঢ়মূল যে একে উত্খাত করা এ সরকারের সাধ্যের মধ্যে কি না, প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। সব নিয়োগের ভিত্তি হবে যোগ্যতা, কথাটার পুনরাবৃত্তি আর শুনতে চায় না মানুষ, এর বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পরবর্তী স্তরগুলো কী হবে—যত শিগগির জানা যায়, ততই ভালো। সরকারের ক্ষমতা ও সদিচ্ছার চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে বাস্তবায়নের পর্যায়ে। সারা দেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, আশা করছে, সরকার উত্তীর্ণ হবে সে পরীক্ষায়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ। সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.