বিমান দুর্ঘটনার স্মৃতি জাদুঘর!

পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বিমানের ধ্বংসাবশেষ, দুমড়ানো-মোচড়ানো ব্ল্যাক বক্স এবং দুর্ঘটনায় নিহত মা-বাবার কফিন আঁকড়ে সন্তানের কান্না—ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার বেদনাবহ এসব স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে জাপানের বিমান সংস্থা। তারা এ স্মৃতি মুছে ফেলতে চায় না। বিমানকর্মী ও সাধারণের প্রদর্শনের জন্য তা ধরে রেখেছে জাদুঘরে।
বিমান দুর্ঘটনার এসব স্মারক টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত দুটো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিমানভীতি আছে—এমন লোকজন হয়তো ওই জাদুঘরের ছায়া মাড়াতে চাইবে না। কিন্তু প্রদর্শনীর আয়োজকেরা বলছেন, বিমানকর্মীদের সামান্য অবহেলার কারণে কত ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সামান্য ভুলে হারিয়ে যেতে পারে কত মানুষের প্রাণ—বিমানকর্মীরা যাতে এটা উপলব্ধি করতে পারেন, সেটা তুলে ধরতেই এ আয়োজন।
জাদুঘরে স্থান পেয়েছে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা বিমানের নানা যন্ত্রাংশ। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে স্ত্রীকে লেখা এক যাত্রীর শেষ চিঠিও ঠাঁই পেয়েছে সেখানে। অনিবার্য মৃত্যুর মুখে থাকা ওই যাত্রীর চিঠিতে ছিল স্ত্রীর প্রতি সন্তানকে দেখেশুনে রাখার আকুতি। জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে আরও একটি মর্মভেদী চিঠি। বাঁচার জন্য মরিয়া এক নারীর আর্তনাদ। মাঝ আকাশে বিমানে আগুন ধরে যাওয়ার পর জরুরি নির্গমন লিফলেটে চিঠিটি লিখে যান তিনি।
জাদুঘর দুটি পরিচালনা করছে জাপানের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা জাপান এয়ারলাইনস (জেএএল) ও জেএলএর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ (এএনএ)। বিমান সংস্থা এএনএর কর্মীদের জাদুঘর পরিদর্শন বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য জেএএল তার কর্মীদের উত্সাহিত করে থাকে।
জেএএলের সেফটি প্রমোশন সেন্টারের প্রধান ইউতাকা কানাসাকি বলেন, জেএএলের সর্বশেষ বিমানটি যখন দুর্ঘটনায় পড়েছিল, তখন তাদের ৫০ হাজার কর্মীর ৯০ শতাংশই চাকরিতে ছিলেন না। তাই বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।
তিনি বলেন, ‘কর্মীদের অবহেলার কারণে যাতে আর কোনো বিমান দুর্ঘটনা না ঘটে, সেটা প্রতিরোধ করতে চাই আমরা। বিমান চলাচলের ঝুঁকিবিষয়ক জ্ঞানও পরবর্তী প্রজন্মকে দিতে চাই।’
বিমানের বেঁকে যাওয়া আসনসহ বিমানের ধ্বংসাবশেষের বিভিন্ন নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে জাদুঘরে। কলম, চশমা, গাড়ির চাবিসহ যাত্রীদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে।
১৯৮৫ সালের ১২ আগস্টের বিমান দুর্ঘটনাকে জেএলএর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছে সংস্থাটি। সেদিন জেএএলের ফ্লাইট ১২৩ সাগরে বিধ্বস্ত হলে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫২০ জন যাত্রী। এ দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান চারজন। বিমান চলাচলের ইতিহাসে একক বিমান দুর্ঘটনায় এটাই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা। ওই দুর্ঘটনার নানা স্মারক স্থান পেয়েছে জাদুঘরে।
সাগর থেকে বিমানের ধ্বংসাবশেষ টেনে তোলার ভিডিও ও স্থিরচিত্র স্থান পেয়েছে সেখানে। স্থানীয় একটি শরীরচর্চা কেন্দ্রে সারি করে রাখা কফিন এবং নিহত এক যাত্রীর স্ত্রী সজল চোখে বিমান সংস্থার প্রধানের সঙ্গে তর্ক করছেন—এ রকম ছবিও স্থান পেয়েছে জাদুঘরে।
জাদুঘরে এসে দর্শনার্থীরা জানতে পারবেন ৫৫ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটেছে মানুষের ভুলের কারণে। অন্য বিমান সংস্থার কর্মীদের ভুলের কথাও সেখানে তুলে ধরা হয়েছে।
একটি ঘটনায়, তাইওয়ানি বিমান সংস্থার একটি বিমানের কো-পাইলট জানতে পারেন, বিমান উড্ডয়নের জন্য ভুল রানওয়ের দিকে যাচ্ছেন পাইলট। কিন্তু ওই কো-পাইলট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে ব্যর্থ হন। মেরামতের জন্য রানওয়েটি তখন বন্ধ ছিল। ফলে উড্ডয়নের ঠিক আগমুহূর্তে দুর্ঘটনায় পড়ে বিমানটি। নিহত হয় এর ৮৩ জন যাত্রী।
অন্য এক ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানের একজন ক্রু অন্য এক কাজে ব্যস্ত থাকায় ওই বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি যথাসময়ে তাঁর চোখে ধরা পড়েনি। ফলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ওই বিমানের ১০৩ জন আরোহীর।
এভাবে বিমানকর্মীদের অসতর্কতার কথা তুলে ধরা হয়েছে জাদুঘরে, যাতে বিমানকর্মীরা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.