বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাল্যবিবাহ অত্যন্ত ভয়াবহ একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমাজে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে যেসব ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো বাল্যবিবাহ। ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়ে অথবা ২১ বছরের কম বয়সের ছেলেদের বিবাহকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বাল্যকাল বা নাবালক বয়সে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিবাহকে বোঝায়। এ ছাড়া বর-কনে উভয়ের বা একজনের বয়স বিয়ের দ্বারা নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তা আইনত বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত হবে। বাল্যবিবাহের কারণে কিশোরী মা ও সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। বিদ্যমান আইনে বিয়ের বৈধ বয়সসীমা ছেলেদের ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮ বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের কারণে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মেয়ে ১৫ বছর বয়সের আগে গর্ভবতী হওয়ার ফলে মা এবং শিশু যেসব মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন তা হচ্ছে—নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া ও কম ওজনের শিশু জন্মদান। অনেক ক্ষেত্রে প্রসবের সময় মা ও সন্তান দুজনেরই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
জনসংখ্যা তত্ত্বের দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক বয়সে বিবাহ সুবিধাজনক। ভবিষ্যতে সন্তানের মা যিনি হবেন, তাঁকে অবশ্যই পরিপক্ব হতে হবে। কম বয়সী ছেলে-মেয়ের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পাদিত হলে পবিত্র কোরআনে যে শান্তি ও সুষমার কথা বলা হয়েছে, তা বিপর্যস্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনিই তোমাদেরকে এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার সঙ্গিনীর সৃষ্টি করেন যেন তার কাছ থেকে পায় শান্তি ও সুখময় বসবাস।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৮৯)
ইসলাম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য নারী বা পুরুষকে বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিপক্ব হওয়া অত্যাবশ্যকীয় বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। তবে বিবাহ সম্পর্কিত পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদিসকে সামনে রেখে জীবনের কঠিন বাস্তবতার আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করলে ক্ষেত্রবিশেষে এটি একেবারে নাজায়েজও বটে। পিতা-মাতা, অভিভাবক বা সামাজিক ও ধর্মীয় নেতারা যদি বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন না হন, তাহলে এর অনুশীলন চলতেই থাকবে। ইলমে ফিকেহর একটি সূত্র হচ্ছে, ‘মুকাদ্দিমাতুল হারামে হারাম’ অর্থাত্ ‘যা হারামের দিকে নিয়ে যায় সেই কাজটিও হারাম’। যে বাল্যবিবাহ ভগ্নস্বাস্থ্য, অপরিকল্পিত পরিবার, দাম্পত্য কলহ, প্রসবকালীন মৃত্যু এবং শিশুর অকাল মৃত্যুসহ অনেক বিপদ ডেকে আনে, সে বিবাহ কখনো ইসলাম অনুমোদিত হতে পারে না।
শারীরিক গঠন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই বিয়ে, অতঃপর সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে বাল্যবধূরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অপুষ্টির মধ্যে শারীরিক নানা উপসর্গ দেখা দেওয়া সত্ত্বেও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে আবারও গর্ভবতী হয় সে। তা ছাড়া গর্ভধারণের বয়সে উন্নীত হওয়ার আগেই অল্পবয়সী বালিকাদের বিয়ে দিলে পরবর্তী সময়ে যে গর্ভসঞ্চার হয়, তা নবজাত শিশু ও মা উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের সামর্থ্য বলতে কেবল দৈহিক সক্ষমতা নয়, আর্থিক সামর্থ্যও থাকতে হবে। ফকিহেদর মতে, ‘কোন্ বয়সে বিবাহ সম্পাদিত হবে, তা শারীরিক ও জৈবিক প্রয়োজন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা দিয়ে বিবেচিত হয়।’
বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আজ সমাজের সর্বস্তরে প্রতিফলিত। একটি মেয়ে তার স্কুলজীবন পেরোনোর আগেই বউ হচ্ছে, মা হচ্ছে। জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার আগেই সে সংসার জীবনে প্রবেশ করেছে। অথচ সমাজের অন্য মেয়েদের মতো শিক্ষিত, স্বাবলম্বী কিংবা সুন্দর জীবনযাপনের ন্যূনতম ধারণার অধিকারী সে হতে পারত। বাল্যবিবাহের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো অপরিণত গর্ভধারণ এবং মাতৃত্ব। প্রতিবছর গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসবকালীন সমস্যার কারণে কমপক্ষে ৬০ হাজার বাল্যবধূ মারাও যায়। বাল্যবিবাহের পরিণতিতে শুধু শিশু, অল্পবয়সী নারী বা তার পরিবারই আক্রান্ত হয় না, এতে দেশ হয় অপুষ্টি ও দুর্বল ভবিষ্যত্ প্রজন্মের উত্তরাধিকারী।
বাল্যবিবাহ নিরোধে জন্মনিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিয়ের সময় জন্মসনদ প্রদর্শন অতি বাধ্যতামূলক আবশ্যক। বাল্যবিবাহে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে নিরাপদ মাতৃত্ব অন্যতম। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সঠিক বয়সকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য যেখানে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে বাল্যবিবাহ ও এর পরিণতিসংক্রান্ত বিষয়ে নিস্পৃহ দৃষ্টিভঙ্গি কোনো ধর্মপ্রাণ সচেতন নাগরিকের কাম্য হতে পারে না।
বাল্যবিবাহ সংকুচিত করে দেয় নারীর পৃথিবী। পিতা-মাতা বা অভিভাবক অথবা সামাজিক নেতারা যদি বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন না হন, তাহলে এর অনুশীলন চলতেই থাকবে। সামাজিক সচেতনতা আর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল বাল্যবিবাহ রোধ করে একটি কন্যাশিশুকে অধিকার সচেতন নারী কিংবা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নারী নিজেই সচেতন হয়ে উঠেছেন। নারী নিজেই যখন বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন, তখন এ ঘৃণ্য অভিশাপ থেকে নিশ্চিতভাবে নারীরা মুক্তি লাভ করবেন। যখন সমাজ, রাষ্ট্র এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে, তখন বাল্যবিবাহের আড়ষ্টতা থেকে নারীরা বেরিয়ে আসবে—এ প্রত্যাশায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.