ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, কার্যক্রম চালালে হতে পারে যে সাজা by রাশিম মোল্লা

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১লা আগস্ট নিষিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অঙ্গসংগঠন। প্রায় তিন মাসের ব্যবধানে বুধবার রাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আইনজীবীদের দেয়া তথ্যমতে, যে আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেই একই আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯’ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো।

২০০৯-এর ধারা ১৮তে  নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তালিকাভুক্তকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারার ১৮ (১) উপধারায় বলা হয়েছে- এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে। ১৮(২)-এ বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোনো ব্যক্তি বা সত্তাকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে বা তফসিল হতে বাদ দিতে পারিবে অথবা অন্য কোনোভাবে তফসিল সংশোধন করিতে পারিবে।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী মো. মহসিন রশিদ। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বহু মানুষকে নির্বিচারে খুন করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের লাশ দাফন ও গোসলেও বাধা দেয়ার সংবাদ মিডিয়ায় দেখেছি। তিনি বলেন, ছাত্রলীগে এক সময় মেধার মূল্যায়ন ছিল। মেধার ভিত্তিতে সবকিছু হতো। কিন্তু ছাত্রলীগ এখন হেন কোনো কাজ নেই যা তারা করে নাই। ছাত্রলীগ ধর্ষণের সেঞ্চুুরি উৎসবও পালন করেছে। গত ১৫/২০ বছর ধরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল ও মাদকের মতো ঘৃণিত কর্মকাণ্ডে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের নারী কর্মীরাও এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ছাত্রলীগের নারী কর্মীরা চরিত্রহীন ও সন্ত্রাসী কর্মাকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আইনে বলা আছে কি কি করলে একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যায়। আর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হতে যা যা করা লাগে তার সব কিছুই করেছে। আমি মনে করি আরও আগেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল। অনেক কোমলমতী ছাত্র এই সংগঠনে যুক্ত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। মূল সংগঠন আওয়ামী লীগও  ছাত্রলীগকে নিবৃত করতে পারেনি। তিনি নিষিদ্ধ এই সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা রুজু ও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান। একইসঙ্গে এই সংগঠনের কোনো সম্পদ থাকলে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ও ব্যাংক একাউন্ট থাকলে ফ্রিজ করার আহ্বান জানান।  

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মামুন মাহবুব মানবজমিনকে বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলা থেকে নারী শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। গত ১৫/২০ বছর ধরে ছাত্রলীগ হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজির মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ছাত্রলীগের নারী কর্মীরাও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের নিষিদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তবে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার চাইতে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিচারেরর মুখোমুখি করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে আরও ভালো হতো। বিষয়টি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারতো না।        
এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, গত ১লা আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। ওই একই আইনের একই ধারায় বুধবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। একইভাবে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারে। তিনি বলেন, এখন থেকে ছাত্রলীগ তার কোনো কর্মসূচি পালন করতে পরবে না। কর্মসূচি পালন করলে তা আইনত অপরাধ। তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি শাহ আহমেদ বাদল বলেন, আগের ছাত্রলীগ আর এখনকার ছাত্রলীগ এক নয়। ছাত্রলীগ এখন ভোগবাদী, সন্ত্রাসী ও নারী ধর্ষণকারী হিসেবে পরিচিত। এই সংগঠনটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হতে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে। তারা আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছে। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে করা আন্দোলনকে ব্যাহত করতে নির্বিচারে হামলা করেছে। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গুলি ছোড়ার ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি ছিল।

নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার শাস্তি:
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসী কাজ করলে, সন্ত্রাসী কাজে অংশ নিলে, সন্ত্রাসী কাজের জন্য প্রস্তুতি নিলে বা সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনে সাহায্য বা উৎসাহ দিলে, সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত কাউকে সমর্থন বা সহায়তা দিলে সেই ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে বিবেচিত হবে। সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. আবুল হোসেন খন্দকার মানবজমিনকে বলেন, সন্ত্রাস দমন আইনের ধারা অনুযায়ী সত্তা বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারী কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যে কোনো সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে। সংগঠন নিষিদ্ধ করা মানে হচ্ছে- এ সংগঠন কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন যদি কার্যক্রম কোনোভাবে চালু রাখে, তাহলে এর বিরুদ্ধে সরকার যে কোনো রকম স্টেপ নিতে পারে।

এই আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৮ এর অধীন কোনো নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য হন বা সদস্য বলিয়া দাবি করেন, তাহলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন এবং উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনের জন্য তিনি অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ১৮ এর অধীন কোনো নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন করিবার উদ্দেশ্যে কাউকে অনুরোধ বা আহ্বান করেন, অথবা নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন বা উহার কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোনো সভা আয়োজন, পরিচালনা বা পরিচালনায় সহায়তা করেন, অথবা বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন। ৯(২) ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নিষিদ্ধ সত্তার জন্য সমর্থন  চেয়ে অথবা উহার কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে কোনো সভায় বক্তৃতা করেন অথবা রেডিও, টেলিভিশন অথবা কোনো মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনো তথ্য সমপ্রচার করেন, তাহলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন। ৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) অথবা (২) এর অধীন কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তিনি অনধিক সাত বৎসর ও অন্যূন দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড ও আরোপ করা যাবে। ১০ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করেন, তাহলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তির দুই তৃতীয়াংশ মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং যদি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বৎসরের কারাদণ্ড হইবে, কিন্তু উহা ৪ (চার) বৎসরের কম হবে না।

১১ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি বা সত্তা অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলে গণ্য হবে এবং উক্ত ব্যক্তি বা উক্ত সত্তার প্রধান, তিনি চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা অন্য যে কোনো নামে অভিহিত হউক না কেন, উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তির দুই-তৃতীয়াংশ মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং যদি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে উক্ত অপরাধের শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর ও অন্যূন ৪ (চার) বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড, এবং উহার অতিরিক্ত সংশ্লিষ্ট সত্তার বিরুদ্ধে ধারা ১৮ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।

১২ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে- (ক) সাহায্য বা সহায়তা করে; বা (খ) সহায়তাকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করে; বা (গ) অন্যদেরকে সংগঠিত বা পরিচালনা করে; বা (ঘ) অবদান রাখে; তাহলে উক্ত ব্যক্তি বা সত্তা অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলে গণ্য হবে এবং উক্ত ব্যক্তি বা উক্ত সত্তার প্রধান, তিনি চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা অন্য যে কোনো নামে অভিহিত হউক না কেন, উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তির দুই-তৃতীয়াংশ মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং যদি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে উক্ত অপরাধের শাস্তি হইবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর ও অন্যূন ৪ (চার) বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে।

সন্ত্রাস দমন আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যুন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনজীবীরা বলেন, দোষী প্রমাণিত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এই আইনের আলোকে শাস্তি দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.