সরজমিন মৌচাক: লিলি প্লাজা মার্কেট দখলের অভিযোগ

রাজধানীর মৌচাকের ‘লিলি প্লাজা’ মার্কেটটি অবৈধভাবে দখল করে নেয়ার অভিযোগ করেছে এর মালিকপক্ষ। ভবনটির উন্নয়নে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল মালিকপক্ষ। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে রাজনৈতিক ও ক্যাডার শক্তি দিয়ে দখলে নিয়ে এর উন্নয়ন কাজ শুরু করেছে। আগের সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকজনকে নিয়ে ডেভেলপার কোম্পানি দখল চেষ্টা চালালেও তা পারেনি। সরকার পরিবর্তনের পর অন্য একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় এবার মার্কেট দখলে নিয়ে তা ভাঙার কাজ শুরু করেছে। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে তারা এই কাজ করে যাচ্ছে। সরজমিন এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে মার্কেটটি দখলের সত্যতা মিলেছে।

ড. মির্জা মাসুদ হোসেন এই মার্কেটের স্বত্বাধিকারী ছিলেন। তিনি ২০২১ সালে মারা যান। মার্কেটটিতে ছিল কয়েকশ’ দোকান। মির্জা মাসুদ মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী মোসলেমা আক্তার মার্কেটটি উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল এই মার্কেটটি। ২০২২ সালে ভিভো বিল্ডার্স নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ভিভো বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দীন আহম্মেদ ও এমডি জুয়েল মুন্সী প্রতারণার আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ করেন মোসলেমা আক্তার।

বর্তমানে ভিভো বিল্ডার্স মার্কেটটি দখলে নিয়ে ‘লিলি প্লাজা’ নাম পরিবর্তন করে ‘মৌমাছি টাওয়ার’ নামে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন। বহুতল ভবন নির্মাণে ভবনটি ভাঙার কাজ চলমান রয়েছে। চুক্তি ভঙ্গ করায় ভিভো ডেভেলপারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারটি।

ভিভো ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী সাইনিং মানির ৬ কোটি টাকা তিন কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা ছিল। প্রথম কিস্তির ২ কোটি টাকা আম-মোক্তারনামা দলিল হওয়ার পর দেয়ার কথা থাকলেও মাত্র ১৩ লাখ টাকা এবং দুইটি দোকানের অগ্রীম গ্রহণ পরিশোধ বাবদ ২০ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা প্রদান করে ওই কোম্পানি। অবশিষ্ট টাকার বিপরীতে আইএফআইসি ব্যাংকের ৪টি চেক প্রদান করলেও সবকটি চেক ডিজঅনার হয়। ভিভো ডেভেলপার কোম্পানি থেকে লিলি প্লাজার মালিকপক্ষ শুধুমাত্র ১৩ লাখ টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা পায়নি। ডেভেলপার কোম্পানি শর্তানুযায়ী কোনো টাকা না দিয়ে রাতের বেলায় এলাকার কিছু ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়ে লিলি প্লাজায় একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয় এবং এই সন্ত্রাসী বাহিনী লিলি প্লাজার দোকান ও অফিসের লোকজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দোকান অফিস ছেড়ে চলে যেতে বলে।

আদালতে মামলা ও জিডি সূত্রে জানা যায়, লিলি প্লাজা মার্কেট ৯৩ নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ, রমনা ঢাক-১২১৭ এর ওয়ারিশসূত্রে মালিক মোসলেমা আক্তার মির্জা, তার ছেলে মির্জা মুন্নাফ বেগ ও মেয়ে নাহরিন মির্জা। মার্কেটটি ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করার জন্য ২০২২ সালে ৪ঠা এপ্রিল ভিভো বিল্ডার্স কোম্পানির সঙ্গে ১৮/সি ৪র্থ তলা র‌্যাকিং স্ট্রিট ওয়ারী, ঢাকা-১২০৩ এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক মোসলেমা ও তার ছেলে ভিভো ডেভেলপার কোম্পানির এমডি মো. জুয়েল মুন্সীকে দলিল নং-১৮৩৮ মূলে রেজিস্ট্রি পাওয়ার করে দেয় এবং মেয়ে নাহরিন মির্জা ২০২২ সালের ২৬শে জুন রেজিস্ট্রি পাওয়ার নামা দলিল নং-৩৩৮৮ মূলে রেজিস্ট্রি পাওয়ার করে দেন কিন্তু ভিভো বিল্ডার্স চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করার কারণে ২০২২ সালের ১লা ডিসেম্বর পাওয়ার অব অ্যাটার্নি আইনে ২০২২ এর ৩ উপধারা মোতাবেক পাওয়ার নামা দলিল দুইটি বাতিলের জন্য লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করে এবং ২০২৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে উপরোক্ত দুইটি রেজিস্ট্রি পাওয়ার নামা বাতিলের জন্য দেওয়ানি মোকাদ্দমা নং-১৫৩/২০২৩ দায়ের করেছেন মোসলেমা আক্তার মির্জা।

সূত্র জানায়, লিলি প্লাজা ও জমির মালিক মির্জা মোসলেমা আক্তার জমিতে মার্কেট করার উদ্দেশ্যে ভিবো ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তিপত্র দলিল সম্পাদন করেছিলেন। বিনিময়ে ভিভো ডেভেলপার মোসলেমাকে নগদ কিছু অর্থসহ দেড় কোটি টাকার কয়েকটি চেক প্রদান করেছিল। কিন্তু সবগুলো চেক ক্যাশ না হওয়ায় বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। বিরোধ মীমাংসার জন্য মার্কেট কমিটি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে দিয়ে এই মর্মে জানিয়েছিল যে, দ্রুত সময়ের মধ্যে চেকগুলো ক্যাশ করে ভিভো বিল্ডার্স এবং এরপরে ভবন নির্মাণে প্লান পাস করাবে। কিন্তু সমঝোতার পরেও ভিভো ডেভেলপার পাওনা টাকা দিতে ব্যর্থ হলে লিলি প্লাজার মালিক মির্জা মোসলেমা বাধ্য হয়ে ভিভো ডেভেলপারের দেয়া সবগুলো চেক ডিজঅনার করে আদালতে মামলা করেন যার মিস মোকাদ্দমা মামলা নং-১৫৩/২০২৩ইং। এরপরেও ভিভো ডেভেলপার আইনের তোয়াক্কা না করে জোরপূর্বক লিলি প্লাজা মার্কেটটি দখলে নিতে বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নিয়ে দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

ভিভো বিল্ডার্সের মালিকরা আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে লিলি প্লাজায় অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় মদত দিয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছেন লিলি প্লাজার ভাড়াটিয়া জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বোমা জাহাঙ্গীর ও ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বাবলু এবং যুবদল নেতা মোস্তফা। এ সকল ব্যক্তিদের নিয়ে ভিভো বিল্ডার্স কর্তৃপক্ষ অস্ত্রের মুখে মার্কেটটি দখল করে নিয়েছে বলেও জানান তারা।

সূত্র মতে, প্রস্তাবিত মার্কেটের জায়গার পরিমাণ কম-বেশি ৭ কাঠা। প্রতি কাঠা সাইনিং বাবদ ডেভেলপার জমির মালিককে ১ কোটি টাকা করে দেয়ার কথা। নির্মাণাধীন বিল্ডিং’র আনুপাতিক হার হবে ৫০ শতাংশ জমির মালিক ও ৫০ শতাংশ ডেভেলপার।
মোসলেমা আক্তার জানান, উপায় না পেয়ে সন্তানদের সম্পদ রক্ষার জন্য ঢাকা ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ভিভো বিল্ডার্স’র বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি চুক্তিপত্র বাতিলের জন্য মামলা করি। মামলা নম্বর-১৫৩/২০২৩। এরপর তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে লিলি প্লাজার মালিকপক্ষ জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে রমনা থানায় ভিভো বিল্ডার্সের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি একটি জিডি করে। জিডি নম্বর-১০৫৯।

গতকাল সরজমিন দেখা যায়, ভিভো বিল্ডার্স কর্তৃক লিলি প্লাজা মার্কেটটি ভাঙার কাজ করছে। ভবনটির সামনে ‘মৌমাছি টাওয়ার’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানানো। ভবনের সামনে পাহারারত অবস্থায় দেখা যায় কয়েকজন ব্যক্তিকে। ৩৪ বছর ধরে ওই ভবনটিতে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন পাটোয়ারী নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এই ভবনটি ভাঙার কাজ চলছে। এখানে ১৫-১৬ তলা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটা বহু পুরনো মার্কেট। আগে লিলি প্লাজা নামে ছিল।

আশপাশে থাকা বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী ও ব্যবসায়ীরা বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এই লিলি প্লাজায় দু’পক্ষের বিরোধ চলছে। হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটেছে। এখানে অনেক ব্যবসায়ীর রুটি-রুজির জায়গা ছিল। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পাঞ্জাবির আইটেমগুলো বিক্রি করতেন। ভবনটিকে ঘিরে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলছে। এখন আবার দেখা যাচ্ছে ভবনের সামনে লিলি প্লাজার পরিবর্তে নতুন সাইনবোর্ড মৌমাছি টাওয়ার। অনেক ব্যবসায়ী দোকানে থাকা তাদের মালামাল ঠিকমতো নিতে পারেননি। বিল্ডিং ভাঙার কারণে যে যেদিকে পারছে চলে গেছে।

মোসলেমা আক্তার মির্জা মানবজমিনকে বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণে আমি ভিভো বিল্ডার্স ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হই। কিন্তু তারা চুক্তি ভঙ্গ করায় আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি।   

ভুক্তভোগী এই নারী বলেন, বিষয়টি নিয়ে থানা  ও সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কারা সম্প্রতি মার্কেট দখলে সহায়তা করেছে, হামলা করেছে তাদের সবার নাম পরিচয় আছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ বা প্রশাসন তাদের নাম জানতে চাইলে সরবরাহ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিভো বিল্ডার্স ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দীন আহম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, অভিযোগগুলো সঠিক নয়। আমার কাছে সকল প্রকার কাগজপত্র রয়েছে।

ভিভো বিল্ডার্স ডেভেলপার কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মো. জুয়েল মুন্সী মানবজমিনকে বলেন, দেশে বর্তমানে যে আইন তাতে যে কেউ চাইলে অন্য জনের বাড়ি দখল করতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা এখন কোনো ডেভেলপার না, জমির মূল মালিক। মোসলেমার সঙ্গে ডিল হয়েছে ১৪তলা ভবন নির্মাণের। তার ননদের অংশটা আমরা সরসরি ক্রয় করেছি। পুরাতন ভবন ভেঙে আমরা ১৪তলা বিল্ডিং করবো মোসলেমা পাবেন ৫০ শতাংশ আর আমরা পাবো ৫০ শতাংশ।

লিলি প্লাজা মার্কেটের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বাবলু তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে বলেন, আমি লিলি প্লাজা মার্কেটের ম্যানেজার আমি কেন দখলে সহযোগিতা করবো। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.