অভিজ্ঞতা আছে তবুও বিদেশ ভ্রমণ by মো. আল-আমিন

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে আসছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই প্রকৌশল সংস্থাটি। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থাকার পরও পরামর্শক নিয়োগ ও বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে এখনো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে এলজিইডি’র। সম্প্রতি দেশের ৬টি সিটি করপোরেশন ও ৮১টি পৌরসভার অবকাঠামোর উন্নয়নে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের অধীনে এসব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি পার্ক, লাইব্রেরি নির্মাণ ও জলাধার তৈরি করা হবে। এই প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অভাবনীয় ব্যয় প্রস্তাবের কারণে প্রকল্পটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যয়ের এসব অসঙ্গতির বিষয়ে আপত্তিও জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। যদিও গত ৭ই অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (আরইউটিডিপি) শীর্ষক এই প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিজেদের দক্ষতা থাকার পরও ঋণের টাকায় দেশি-বিদেশি পরামর্শক এবং বিদেশ ভ্রমণের পেছনে এতবড় অঙ্কের টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা অযৌক্তিক।

পিইসি সভায় অতিরিক্ত ব্যয় ও অপ্রয়োজনীয় খাত নিয়ে প্রশ্ন: উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯০১ কোটি ২২ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি ৬০ লাখ দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৬২ লাখ দেবে সরকার। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের জুন। তবে আলোচ্য প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পিইসি সভার কার্যপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে ৩১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে কার্যপত্রে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সাধারণত পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, ফুটপাথ, ড্রেন নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন কার্যক্রমগুলো করে থাকে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব। তারপরও এত সংখ্যক বিদেশি ও দেশি পরামর্শক প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নেই। কার্যপত্রে অতি প্রয়োজন ছাড়া পরামর্শক খাতে যথাযথভাবে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এদিকে বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়ার বিষয়েও একই অভিমত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। বলছে, প্রকল্পের আওতায় যেসব কাজ করা হবে, সেগুলো এলজিইডি’র নিয়মিত কাজ। এই কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। তাই প্রকল্প থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। অন্যদিকে প্রকল্পটিতে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ কাদের দেয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, সেটিও জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ খাতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যেটিকে অত্যধিক উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলা হয়।
ওদিকে কমিশন সূত্র বলছে, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৬১৩টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এত সংখ্যক গাড়ি কেনার প্রস্তাবের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও এত গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন।  প্রকল্পের আওতায় অফিস সরঞ্জাম হিসেবে ৪০০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ৭০টি ল্যাপটপ বাবদ ১ কোটি ৭ লাখ, ১০০ ফটোকপিয়ার বাবদ ২ কোটি এবং ১২টি প্রজেক্টর বাবদ ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া এলজিইডি’র দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ৩৯০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৪০ লাখ, একটি মাল্টি ফাংশন প্রিন্টার বাবদ ১ লাখ, একটি ফটোকপিয়ার বাবদ লাখ টাকা, ফার্নিচার বাবদ ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি এবং ফার্নিচার কেনার প্রস্তাবেও আপত্তি ছিল পরিকল্পনা কমিশনের। এত আপত্তি সত্ত্বেও প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রকল্প সম্পর্কে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ডিপিপিতে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নগরসমূহে স্থানান্তরিত হচ্ছে। দেশের পৌরসভাগুলোতে অবকাঠামো, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনসহ পরিবেশ দূষণের সমস্যা রয়েছে। এ সকল সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এমজিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৪টি সিটি করপোরেশন ও ২৪টি পৌরসভার অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের ফলো-আপ প্রকল্প হিসেবে রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরইউটিডিপি) প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। সেক্ষেত্রে একই ধরনের প্রকল্প আগে করা হলেও নতুন করে পরামর্শক ও বিদেশে প্রশিক্ষণ খাত থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশেষজ্ঞরা।  

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত প্রতিটি প্রকল্প খতিয়ে দেখা। কোনোভাবেই টাকা অপচয় করা যাবে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এখনো পরামর্শক ও বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ খরচ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব পালন করা গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তখন তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।

No comments

Powered by Blogger.