আন্দোলনে আহত: এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তারা by সুদীপ অধিকারী
শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতালের) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দালনে আহত হয়ে এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৮ শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ২১ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেও এখনো হাসপাতালের ‘বি’-ওয়ার্ডে ৫৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, আন্দোলনে আহতদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মাল্টিপল ইঞ্জুরি রয়েছে। হাড় ভাঙার সঙ্গে তাদের শরীরের মাংসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সম্পূর্ণ বিনা খরচে তাদের চিকিৎসা চলছে। আন্দোলনের প্রথম দিকে ক্যাজুয়ালিটি-১, ক্যাজুয়ালিটি-২ সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাসেবা দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে আহতদের জন্য হাসপাতালের তিন তলা ও চার তলায় বিশেষায়িত ইউনিট খোলা হয়েছে। সেখানেই এই ৫৯ জনের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ওই তালিকায় নাম রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সাদ আব্দুল্লাহর। পঙ্গু হাসপাতালের ৩ তলার ‘বি’-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়াদের মধ্যে তিনিও একজন। গত ৭ই আগস্ট থেকে তিনি হাসপাতালটিতে ভর্তি। ১৯ বছরের এই শিক্ষার্থী বলেন, সরকার পরিবর্তনের আগের দিন গত ৪ঠা আগস্টের আন্দোলনে তার ডান পায়ে গুলি লাগে। একাধিক অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করার পর পায়ে স্টিলের রডের খাঁচা লাগিয়ে দিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ক্ষত-বিক্ষত হাড় জোড়া লাগানোর জন্য অন্তত ৯ মাস এভাবেই পায়ে খাঁচা লাগানো থাকবে। এর পর আবারো পায়ে অস্ত্রোপচার করে এই খাঁচা বের করা হবে। তবে পা আগের মতো স্বাভাবিক হবে না। আমি আর কোনোদিনও আগের মতো পা ভাঁজ করতে পারবো না। গুলি লাগার বিষয়ে সাদ বলেন, গত ৫ই আগস্ট দুপুরে হাসিনা সরকারের পতনের খবরে সকলে যখন আনন্দ করছিল, সে সময় আমিও মিরপুর এলাকায় মিছিল দেখতে গিয়েছিলাম। মিছিলটি মিরপুর-১ থেকে ২ নম্বরের দিকে এগুতেই হঠাৎ পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে। তখন ভয়ে আমি ওভার ব্রিজের উপর ওঠে পড়ি। পুলিশ তখন ওই ব্রিজের উপর উঠে আমার পায়ে গুলি করে। গুলিতে আমার বাম পায়ের হাঁটুর হাড় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে কয়েকজন মিলে আমাকে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমার পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। দুইদিন থাকার পর সেখানকার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে এই হাসপাতালে চলে আসি। তখন থেকে এখানেই চিকিৎসা নিচ্ছি। হাঁটতেও পারি না, চলতেও পারি না। বিছানায় খাওয়া, বিছানাতেই সব। কবে আমি এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো তার ঠিক নেই। সাদের মতো গত ৫ই আগস্ট ডানপায়ে গুলিবিদ্ধ হয় দশম শ্রেণির ছাত্র আলী হাসান। তাকে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসান বলেন, অনেক চেষ্টার পরও গত ১৪ই আগস্ট আমার ডান পা হাঁটুর নিচে থেকে কেটে ফেলতে বাধ্য হয় ডাক্তাররা। ১৬ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর ৩০শে আগস্ট আমি সাতক্ষীরা ফিরে যাই। কিন্তু বাড়ি ফিরে স্ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আমার পায়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এরপর আবারো পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসে আমার পরিবার। অশ্রুশিক্ত হয়ে হাসান বলেন, সারা জীবনের মতো আমার পা-টা হারালাম। এখন আমার বাবা-মাকে কে দেখবে!
এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সাড়ে ৭শ’ জন চিকিৎসা নিয়েছেন শেরে বাংলা নগর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে। তাদের কেউ এক চোখ, আবার সারাজীবনের মতো নিজের দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এসব রোগীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, আন্দোলনে আহত হয়ে এ পর্যন্ত আমাদের এখানে সাড়ে ৭০০ মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়াও ৫৫০ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো হাসপাতালের ৪ তলার স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড ইউনিটে ৪০ জন ভর্তি রয়েছেন। তিনি বলেন, মূলত আমাদের এখানে চিকিৎসা নেয়া প্রায় সকলের চোখেই একাধিবার অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। কারও একবার। কারোর দুইবার। অনেকে আবার আসছেন চেকআপ করাতে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এমনকি চীন, নেপালের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসক দল আমাদের হাসপাতালে এসে এসব রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। আমরা এসব রোগীদের জন্য স্পেশাল কেয়ার ইউনিট চালু করেছি। বিশেষায়িত চিকিৎসকদের বোর্ড বসিয়ে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। চোখে গুলি লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক রোগীকে আমরা দেখেছি ছররা গুলি চোখের মণি ভেদ করে চলে গেছে। তাদের এসব গুলি বের করতে গিয়ে আরও রক্তক্ষরণ হতে পারে, মণি ছোট হয়ে যেতে পারে, চোখের শেপ নষ্ট হতে পারে তাই অধিক ক্ষতির ভয়ে সারা জীবন তাদের চোখে বুলেট নিয়েই বাঁচতে হবে। এমনই একজন সিলেটের সুজন আহমেদ (২২)। তিনি বলেন, প্রথম থেকেই সিলেটের আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। গত ২৪শে জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলি এসে লাগে আমার ডান চোখে। এরপর আমার সঙ্গীরা উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বলা হয়- আমার চোখের মধ্যে গুলি ঢুকে গেছে। ঢাকা ছাড়া চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। এরপর আমি ঢাকায় চলে আসি। এখানে আসার পর ডাক্তাররা আমাকে জানান, আমার চোখরে মধ্য থেকে গুলি আর কোনোদিন বের করা যাবে না। যদিও যায় তার পরও কোনোদিন আর আমি ডান চোখে দেখতে পারবো না। ১৯শে জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় বাম চোখে গুলিবিদ্ধ হন রিপন আহমেদ। ১০ মাসের সন্তান ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চার তলায়। রিপন বলেন, আন্দোলন যখন তুঙ্গে সকলে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে, তখন আমিও আর বসে থাকতে পারিনি। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দেই। সেদিন পুলিশের গুলিতে একের পর এক নিহতের খবর আসছিল। পুলিশ নির্বিচারে গুলি করছিল। আমরাও রাস্তা ছাড়িনি। এরইমধ্যে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে আমার চোখে। চোখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছিল তখন। আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি। একপর্যায়ে আমার জ্ঞান হারিয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফেরে আমি তখন হাসপাতালে। এরপর সেখান থেকে আমাকে এই চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেদিন প্রাণে বাঁচলেও চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেছে সারাজীনের মতো। আমার ১০ মাসের বাচ্চা ও স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। আমার পারিশ্রমেই তাদের মুখে অন্ন জুটতো। এখন তো কাজও করতে পারবো না। অন্ধ লোককে কেউ কাজেও নিবে না। আমার বাচ্চাটাকে কীভাবে বড় করে তুলবো, কীভাবে সংসারের খরচ মেটাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। একইদিনে রাজধানীর বাড্ডার গোদারাঘাট এলাকায় চোখে গুলিবিদ্ধ হন মো. সাজ্জাদ হোসেন। সাজ্জাদ বলেন, সেদিন জুমার নামাজের পর অন্যদের সঙ্গে আমিও বাড্ডার আন্দোলনে যোগ দিই। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি ছুড়ছিল। সেই গুলির একটি এসে লাগে আমার ডান চোখে। তারপর থেকে আমি আর এই চোখটা দিয়ে কিছুই দেখতে পারছি না।
অপরদিকে গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও এসব রোগীদের চিকিৎসার জন্য তিনটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড খোলা হয়। বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে বাড়িতে ফিরলেও এখনো হাসপাতালটির ৪ তলার ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদেরও কারোর পায়ে গুলি লেগেছে, কারও হাতে, কারও পেটে। সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, আন্দোলনে আহত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে আমাদের হাসপাতালে ৫ শতাধিক মানুষ ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের বেশির ভাগই ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। তবে এখনো ৬ জন ভর্তি রয়েছেন। আমরা তাদের বিষয়ে বিশেষ নজর রাখছি। আন্দোলনে আহত হয়ে অন্তত ২৭শ’ জন চিকিৎসা নিয়েছেন ঢাকা মেডিকের কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আন্দোলন চলাকালীন অনেকেই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কাউকে অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। আর গুরুতর ৮৯০ জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো বেশ কয়েকজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের জন্য সার্বক্ষণিক ডিউটি ডাক্তার ও নার্স রয়েছেন।
No comments