কেমন ছিল সালাউদ্দিনের ‘১৬ বছর’

অনেকের মতেই কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফুটবল তারকা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি হিসেবে খেলোয়াড়ি জীবনের সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বিরাট তারকা খ্যাতি নিয়ে সভাপতি পদে ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। তার দীর্ঘ দায়িত্ব কালে দেশের ফুটবল তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। তার সময়ে ফিফা কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছেন বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ।  ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে অবনমন ঘটেছে জাতীয় ফুটবল দলের। তার ১৬ বছরে শুধু মেয়েদের সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়া বলার মতো কোনো ঘটনাই খুঁজে পাওয়া যাবে না বাংলাদেশের ফুটবলে।

র‌্যাঙ্কিংয়ে শুধুই অবনমন
২০০৮ সালের মে মাসের ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৫। বর্তমানে বাংলাদেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিং ১৮৫। এক সময় বাংলাদেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিং ২০০ ছুঁইয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০১৭ সালে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৯৭তম স্থানে, যা কিনা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন র‌্যাঙ্কিং।

জাতীয় দলের ব্যর্থতা
তার সময়ে জাতীয় দল সবচেয়ে ব্যর্থ। সাত সাফের ছয়টিতে গ্রুপ থেকে বাদ পড়েছে। তারপরও ২০১৯-এ বলেছিলেন তার দৃষ্টিতে ৫০ বছরের সেরা জাতীয় দল এটিই।  এ পর্যন্ত হওয়া সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ১৪টি আসরের মধ্যে ৯ বার চ্যাম্পিয়ন প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারত নিয়মিত খেলে এশিয়ান কাপে। অথচ বাংলাদেশ সাফেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না ১৯ বছর। এমনকি সালাউদ্দিনের ১৬ বছরে একটি বার ফাইনাল খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। সাফে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ২০০৩ সালে। কাজী সালাউদ্দিন সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাফল্য দুবার সেমিফাইনালে ওঠা। ২০১৬-তে থিম্পুতে এশিয়ান কাপ প্রাক-বাছাইয়ে ভুটানের কাছে হার বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজ্জা। সেটিও টপকে গেছে ক’দিন আগে অপেশাদার দল সিশেলসের কাছে হারে।  

সোহাগের নিষেধাজ্ঞা ও সালাম মুর্শেদীর জরিমানা
বাফুফে সভাপতি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন মাঠের ফুটবলে যতটা না আলোচনায় ছিলেন, এর চেয়েও বেশি আলোচনায় ছিলেন মাঠের বাইরের ঘটনায়। বাফুফের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর ফিফা তদন্ত করছিল, সেটাই কখনও স্বীকার করেননি কাজী সালাউদ্দিন। বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ তার পক্ষে সাফাই দিতে জুরিখে ফিফা সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিন সহকর্মীকে নিয়ে। সেটাও নাকি জানতেন না বাফুফে সভাপতি! পরে বাফুফের বিভিন্ন খরচে অনিয়ম, জালিয়াতি ও মিথ্যাচারের অভিযোগে ফিফা ২০২৩ সালের ১৪ই এপ্রিল নিষিদ্ধ করে সোহাগকে। বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে বাফুফের দ্বিতীয় ব্যক্তি সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ফিফা ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যা নজিরবিহীন।

কোচ পরিবর্তন
সালাউদ্দিনের ১৬ বছরে জাতীয় দলের কোচ পরিবর্তন হয়েছে ২৩ বার। কখনো দেশি, কখনো বিদেশি। কখনো স্থায়ী, কখনো অন্তর্বর্তী কোচের ওপর আস্থা রেখে, আবার আস্থা হারিয়েছেন।

ফিফার অনুদান বন্ধ অস্বীকার
তার শেষ মেয়াদে আর্থিক অনিয়ম আর অসংগতির কথা বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু বারবারই যাকে ভুল আখ্যা দিয়েছেন সভাপতি।

সাংবাদিকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য ও ক্ষমা চাওয়া
২০২৩ সালে এক আলোচনা সভার শুরুতে সাংবাদিকদের তাচ্ছিল্য করেন। এ সময় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘জার্নালিস্টরা এখানে ঢুকতে গেলে তাদের আমার এখানে ফটো দিতে হবে তাদের মা-বাবার। আরেকটা কন্ডিশন হলো তারা বাপের ফটো পাঠাবে, জুতা পরা। ঠিক আছে (হাসি)? এটা হতে হবে মেন্ডেটরি। বাপের জুতা পরা ছবি থাকতে হবে।’ যদিও পরে তোপের মুখে পড়ে ক্ষমা চান তিনি।

নারী দলকে অলিম্পিক বাছাই খেলতে না পাঠানো
গত বছর এপ্রিলে সাফজয়ী নারী ফুটবল দলকে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলতে না পাঠিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েন কাজী সালাউদ্দিন। এজন্য তারা ৯২ লাখ টাকা চেয়েছিল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে। মিয়ানমার যাওয়ার জন্য এত টাকা শুনে অনেকে ভ্রু কুঁচকাবেন। এরপরও মন্ত্রণালয়ের জবাবের অপেক্ষা না করে টাকা চাওয়ার মাত্র একদিন পরই বাফুফে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেয়, অর্থাভাবে দল পাঠাতে পারছে না। ফুটবল অঙ্গনে গুঞ্জন, সাবিনা খাতুনরা নিজেদের বেতনসহ সুযোগ সুবিধার দাবি জানিয়ে অনুশীলন বয়কট করেছিলেন। সেই শাস্তিই নাকি দিয়েছিলেন কাজী সালাউদ্দিন এভাবে দলকে অলিম্পিকে না পাঠিয়ে।

জেলার ফুটবলকে পাঠিয়েছেন হিমাগারে
তার ১৬ বছরের সময়কালে জেলা লীগ আয়োজনে দু-তিনবার জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে অর্থ দিয়েছেন সালাউদ্দিন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলো সক্রিয় করতে পারেননি। লীগ না করলে শাস্তি দিতে পারতেন সংশ্লিষ্ট জেলাকে। অনেকের মতে, সেটা করেননি নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই। ফলে জেলার কর্মকর্তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। তাদের অনেকেই বাফুফের নির্বাচনের সময় ঢাকায় এসে ‘উপঢৌকন’ নিয়ে বাড়ি ফেরেন বলে গুঞ্জন আছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.