প্রথম বিতর্কে ধরাশায়ী ট্রাম্প by হাসান ফেরদৌস
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক নাটকীয়তার জন্য যতটা পরিচিত, গুরুত্বপূর্ণ নীতি (পলিসি) প্রশ্নে অর্থপূর্ণ আলোচনার জন্য ততটা নয়। মঙ্গলবারের বিতর্ক আদৌ এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। কমলা দক্ষ কৌঁসুলি। অন্যদিকে ট্রাম্প ঝানু ‘শো ম্যান,’ টেলিভিশন মাধ্যমটা তিনি খুব ভালো জানেন। কিন্তু নিজের মেজাজ সামলে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া তাঁর জন্য কঠিন। কমলার লক্ষ্য ছিল ট্রাম্প তাঁর মেজাজ হারান, এমন মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া। ঠিক সে কাজটিই করেছেন তিনি।
বিতর্কে পাঁচ বিষয়
অর্থনীতি, অভিবাসন, গর্ভপাত, বর্ণবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর হামলা—মোটের ওপর পাঁচটি বিষয়েই বিতর্ক আবর্তিত হয়। সঙ্গে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ এবং স্বাস্থ্যবিমা প্রসঙ্গ বিতর্কে ঝাঁজ ও রস দুটিই সরবরাহ করে।
বিতর্কের প্রথম ১৫ মিনিট ট্রাম্প মোটের ওপর নিজেকে সামলে ছিলেন। অর্থনীতি প্রশ্নে অধিকাংশ মার্কিন ভোটার তাঁর নেতৃত্বের ওপর অধিক আস্থাবান। সে কথা মাথায় রেখে ট্রাম্প কমলাকে ভালোই ঠুকেছিলেন। তাঁর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখনকার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। কিন্তু অভিবাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই খেই হারিয়ে ফেলেন ট্রাম্প। তাঁর প্রচারশিবিরের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় অভিবাসন। নির্বাচিত হলে তিনি এক কোটির বেশির বহিরাগতকে জোর করে বহিষ্কার করবেন বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। এত লোককে কীভাবে বহিষ্কার করবেন, এমন একটি প্রশ্নের কোনো উত্তরই তাঁর কাছে ছিল না। উল্টো ওহাইওতে অবৈধ বহিরাগতরা স্থানীয়দের কুকুর-বিড়াল চুরি করে খাচ্ছে, এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলেন। বিতর্কের সঞ্চালকদের একজন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন কথাটা মিথ্যা।
ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, অবৈধ অভিবাসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে, আর সে জন্য দায়ী কমলা ও বাইডেনের ব্যর্থ নেতৃত্ব। সে প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন কমলা। তিনি ট্রাম্পকে মনে করিয়ে দেন অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানদের যৌথ উদ্যোগে একটি আইন প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু ট্রাম্পের নির্দেশে রিপাবলিকান সদস্যরা শেষ মুহূর্তে সে প্রস্তাব সমর্থনে অস্বীকার করেন। কেন? শুধু এ জন্য যে এই প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি কমলাকে আক্রমণের সেরা হাতিয়ারটি হারাতেন। অন্য কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নয়, শুধু নিজের স্বার্থই মাথায় রাখেন ট্রাম্প।
বিতর্কের আগে সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন কমলাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘সুযোগ পেলেই ট্রাম্পকে উত্তেজিত করবে, তাতেই কাজ হবে।’ হলোও তা-ই। অপ্রাসঙ্গিক হলেও কমলা ট্রাম্পের সভার জনসমাগম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। ক্যামেরায় চোখ রেখে বললেন, ‘আপনারা এক কাজ করুন। ট্রাম্পের কোনো নির্বাচনী সভায় একবার ঘুরে আসুন। দেখবেন তিনি একের পর এক অসংলগ্ন বিষয়ে কথা বলছেন। কাল্পনিক “সিরিয়াল কিলার” হ্যানিবাল লেকটারকে নিয়ে আবোলতাবোল কথা বলছেন। উইন্ডমিল বা বায়ুকল থেকে নাকি ক্যানসার হয়, এমন কথাও আপনারা শুনবেন। তারপর দেখবেন একসময় বিরক্ত হয়ে লোকজন সভা ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করেছে। সভায় তারা ট্রাম্পের এত এত কথা শুনবে, কিন্তু যা শুনবে না তা হলো আপনাদের জন্য তিনি কী করবেন।’
ব্যস, অমনি লালমুখো হয়ে ট্রাম্প বললেন, ‘সব মিথ্যা কথা। কেউ আমার সভা ছেড়ে যায় না। আমার সভা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সভা।’
কমলাকে আক্রমণের জন্য জুতসই ইষ্টকখণ্ড হাতের কাছে না পেয়ে ট্রাম্প বারবার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথায় চলে যান। বাইডেন অথর্ব, দিনভর কাজকর্ম না করে সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। তিনি ও তাঁর ছেলে কখনো চীন, কখনো মস্কোর কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উৎকোচ পেয়েছেন। একপর্যায়ে ট্রাম্প প্রায় চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘বাইডেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট, তিনি এখন কোথায়? নেই, কোনো জায়গায় তাঁকে পাবেন না।’
মুখে বাঁকা হাসি, চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে কমলা স্মরণ করিয়ে দেন, ‘তিনি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, বাইডেন নন।’
বর্ণ প্রসঙ্গটিও আলোচনায় উঠে আসে। ইতিপূর্বে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, কমলা একবার কালো মানুষ, একবার এশীয় হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন, যখন যেটা রাজনৈতিকভাবে তাঁর কাছে লাভজনক। মঙ্গলবারের বিতর্কে ট্রাম্প সে কথা পুনরাবৃত্তি করলে কমলা মন্তব্য করেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এমন একজন লোক দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চান যে বারবার বর্ণবিভাজনকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শুধু এখন নয়, সারা জীবন ট্রাম্প এই কাজ করেছেন।’ কমলা স্মরণ করিয়ে দেন, অর্ধশতক আগে বাবার টাকার ব্যবসায় নেমে ভাড়ার জন্য যে বাড়ি তিনি বানিয়েছিলেন, তাতে কৃষ্ণকায়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
সবচেয়ে হাস্যকর মুহূর্ত ছিল স্বাস্থ্যবিমা প্রশ্নে ট্রাম্পের উত্তর। আট বছর ধরে তিনি বলে আসছেন, ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচিটি বাতিল করে তিনি আরও ভালো, আরও দক্ষ একটি স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি চালু করবেন। কী সেই কর্মসূচি, এত দিনে কি সেই কর্মসূচি তিনি ভেবে উঠেছেন কি না, তা জানতে চাইলে ট্রাম্প জবাব দেন, একটা ধারণা (কনসেপ্ট) তাঁর মাথায় আছে। অর্থাৎ তিনি এখনো ভাবছেন।
কমলা মনে করিয়ে দেন, ৬ জানুয়ারির দাঙ্গার মাধ্যমে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আবার ক্ষমতা ফিরে পেলে একনায়ক হতে চাইবেন। কমলা মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্যরাই তাঁকে অযোগ্য ও হাস্যকর বলে তিরস্কার করেছেন। বিশ্বনেতারা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। জবাবে ক্ষিপ্ত ট্রাম্প বলেন, মোটেই না, বিশ্বনেতারা তাঁকে মহান বলে অভিনন্দিত করেছেন। এই দাবির সমর্থনে একমাত্র যে বিশ্বনেতার নাম তিনি উল্লেখ করেন, তিনি হলেন হাঙ্গেরির কর্তৃত্ববাদী নেতা ভিক্টর অরবান।
বিতর্কের ফলাফল
অধিকাংশ ভাষ্যকার একমত, এই বিতর্কে হাসিখুশি ও চটপটে কমলার পাশে ট্রাম্পকে দেখাচ্ছিল ক্রুদ্ধ, বিরক্ত ও খুঁতখুঁতে এক বৃদ্ধ। সিএনএনের ভ্যান জোন্স মন্তব্য করেছেন, বলা যায়, কমলা তাঁর প্রতিপক্ষকে কশে বেত্রাঘাত করেছেন। ‘পলিটিকো’ একজন রিপাবলিকান নির্বাচনী বিশেষজ্ঞের কথা উদ্ধৃত করে লিখেছে, বিতর্কের জন্য ট্রাম্প মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। পুরোনো কথাগুলোই নতুন করিয়ে ঢেলে দিয়েছেন, কিন্তু হুল ফোটাতে পারেননি।
কমলা ও তাঁর প্রচারশিবির বিতর্কের ফলাফলে দারুণ খুশি। এতটাই খুশি যে তারা আরেক দফা বিতর্কের প্রস্তাব করেছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, কমলা নয়, তিনিই জিতেছেন। কমলার হার হয়েছে বলেই তিনি এখন আরেক দফা বিতর্কের দাবি তুলেছেন।
এই বিতর্কের আগে অধিকাংশ জনমত জরিপে ট্রাম্প ও কমলার অবস্থান ছিল সমানে সমান। সে কারণেই সবাই এই বিতর্কের অপেক্ষায় ছিল। যে ১৫ শতাংশ ভোটার এখনো মনস্থির করে ওঠেননি, তাঁরা হয়তো এই বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তাঁরা কোন দিকে ঝুঁকছেন, কমলা না ট্রাম্প? সে জরিপ জানার জন্য আমাদের অবশ্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে যাঁরা মনস্থির করে ফেলেছেন, তাঁদের একজন হলেন টেলর সুইফট, বিশ্বের এক নম্বর সেলিব্রিটি পপতারকা। বিতর্ক শেষ হওয়ামাত্রই ইনস্টাগ্রামে এক বার্তায় তিনি জানান, কমলার পক্ষেই তিনি ভোট দেবেন। সম্ভবত এটাই ছিল এই মুষ্টিযুদ্ধের সেরা ‘আপারকাট’।
No comments