খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা: এবার বন্ধ হলো ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার উৎপাদন
অন্তর্বর্তী সরকার কি খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে? একের পর এক সারকারখানা বন্ধ, ডলার সঙ্কটে সার আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারায় এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সারের যে মজুদ রয়েছে তা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এই সার দিয়ে চলমান আমন, আউশসহ অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কৃষক। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া দেশের সবচেয়ে বড় রবি মৌসুমে সারের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সে সময় সারের চাহিদা থাকে বেশি। সেই চাহিদা মেটাতে জরুরি ভিত্তিতে ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া সার আমদানি করতে হবে। কিন্তু পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যে লুটপাট হয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায়। পাচার হয়েছে অন্তত ১৮ লাখ কোটি টাকা। রিজার্ভ ঘাটতির কারণে ডলার সঙ্কটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। এতে কয়েক মাস ধরে বন্ধ আছে সার আমদানি।
এ আশঙ্কার মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হজরত শাহজালাল সারকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম। এ অবস্থায় আগামী বোরো ও সরিষা মৌসুম নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে খাত সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এমনিতেই চলমান বন্যায় এবার আউশ ও আমন মিলে প্রায় সাত-আট লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন কম হবে। এ ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে আগামী বোরো মৌসুমকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল; কিন্তু এলসি সমস্যার সমাধান না হওয়া এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে হুমকি দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে যতগুলো সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, যদি সময় মতো সার আমদানি করা না যায়, দেশে উৎপাদন বাড়ানো না যায়, তাহলে কৃষি উৎপাদনে বড় সমস্যা হবে। দেশের খাদ্যনিররাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
এ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষিসেবা বিভাগের ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) চলতি মাসের গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের (গেইন) ‘গ্রেইন অ্যান্ড আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার বন্যায় বাংলাদেশের ২৪টি জেলার প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমির আউশ ও আমন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার এই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের চাল উৎপাদনে। এবার আউশ মৌসুমে তিন লাখ টন এবং আমন মৌসুমে চার লাখ টন, সব মিলিয়ে চালের উৎপাদন কম হতে পারে সাত লাখ টন। এতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করা লাগতে পারে।
মার্কিন কৃষি বিভাগ বলছে, গত অর্থবছরে এক কোটি ৪৬ লাখ টন আমন চাল উৎপাদন হলেও চলতি অর্থবছরে তা এক কোটি ৪২ লাখ টনে নেমে আসতে পারে। এ ছাড়া আউশের উৎপাদন ২৪ লাখ টন থেকে ২১ লাখ টনে নামতে পারে। সবমিলিয়ে এ দুই মৌসুমে চালের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে সুখবর থাকবে আগামী বোরো মৌসুমে। বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন পাঁচ লাখ টন বাড়তে পারে। এ মৌসুমে মোট চালের উৎপাদন দুই কোটি টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দুই কোটি পাঁচ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। সবমিলিয়ে আগামী মৌসুমে চালের উৎপাদন হতে পারে তিন কোটি ৬৮ লাখ টন; গত অর্থবছরে যা ছিল তিন কোটি ৭০ লাখ টন। ফলে তিন মৌসুম মিলিয়ে দেশে চালের উৎপাদন কমতে পারে দুই লাখ টন।
বন্ধ হলো ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদন : জানা যায়, একসময় নিজস্ব উৎপাদিত ইউরিয়া সার দিয়েই দেশে কৃষি আবাদের চাহিদা মিটতো। আমদানি করতে হতো শুধু নন ইউরিয়া সার। কিন্তু গ্যাস সঙ্কটের কারণে গত ছয় মাসে দেশের পাঁচটি সারকারখানার মধ্যে তিনটিই বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ গতকাল সকালে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হজরত শাহজালাল সারকারখানা। বিসিআইসি’র পরিচালক (উৎপাদন) শাহীন কামাল জানান, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কারখানাটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হন তারা। এই কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টন ইউরিয়া সার উৎপান হতো বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। প্রায় ছয় মাস আগে বন্ধ হয়ে যায় জামালপুরের সরিষাবাড়ি যমুনা সারকারখানার উৎপাদন। প্রায় একই সময়ে বন্ধ হয়ে যায় আশুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম। তার আগে বন্ধ হয় চট্টগ্রামের সিইউএল সারকারখানার উৎপাদন। এখন শুধু চালু আছে ঘোড়াশাল (পলাশ) সারকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম।
বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, পাঁচটি সারকারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার ৫০০ টন থেকে সাত হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হতো; কিন্তু বন্ধ হতে হতে দেশের ইউরিয়া সার এখন নন ইউরিয়ার মতোই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে।
বিসিআইসি ও বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে চার লাখ ৩৫ হাজার টন ইউরিয়া সার মজুদ রয়েছে। নন ইউরিয়ার মধ্যে টিএসপি প্রায় তিন লাখ টন, ডিএপি সাড়ে তিন লাখ টন এবং এমওপি মজুদ আছে প্রায় চার লাখ টন। মজুদ থাকা ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন কৃষি সচিব ড. মো: এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। গত ৮ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিজ কক্ষে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএআরএফ) কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘সারের বর্তমান মজুদ দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানো যাবে। তবে সার আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে এখনো কিছুটা সঙ্কট রয়েছে, যেটা আমরা সমাধানে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।’
বন্যার কারণে দেশ খাদ্যঘাটতিতে পড়বে কি না- জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আগামী মৌসুমে বোরো উৎপাদনে কোনো সমস্যা না হলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কোনো সঙ্কট হবে না। তাই এখন আমাদের টার্গেট, আগামী বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদন করা।’
বিসিআইসি ও বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। গত তিন মাস যাবৎ সার আমদানি বন্ধ আছে। প্রায় সাত-আট লাখ টন নন ইউরিয়া (টিএসপি, ডিএপি এমওপি) সার আমদানির জন্য টেন্ডার হলেও এলসি সমস্যার সমাধান না হওয়ায় আমদানিকারকদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। আমদানির সাথে যুক্ত একজন জানান, এই মুহূর্তে যদি এলসি সমস্যার সমাধানও হয়, এরপরও রবি মৌসুমের শুরুতে সার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল সন্ধায় নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার ইতোমধ্যে ৬০ হাজার টনের বেশি সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া সারও রয়েছে। আমদানি করতে হলে যে টাকা লাগে দেশে উৎপাদন করলে তা অনেক কমে করা যায়। তিনি বলেন, দেশের পাঁচটি সারকারখানা সচল রেখে ইউরিয়া সার পুরোদমে উৎপাদন করলে ৩০-৩২ লাখ টন উৎপাদন করা যায়। এটি হলে আর আমদানি করতে হয় না; কিন্তু এখন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় পাঁচটি কারখানার মধ্যে চারটিই বন্ধ হয়ে গেছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, একসময় ইউরিয়া সারের চাহিদার বেশির ভাগই আমরা উৎপাদন করতাম। এখন ৩০ শতাংশেরও কম উৎপাদন করতে পারি। তা-ও আবার আরেকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। বিসিআইসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ইউরিয়া উৎপাদন করতে। আমদানির জন্য তো বিসিআইসি প্রতিষ্ঠা হয়নি; কিন্তু এখন সেটিই হচ্ছে। এটা ভালো কথা নয়।
তিনি বলেন, যেখানে আমাদের সারকারখানা আছে। উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। গ্যাস ব্যবহার অন্য জায়গায় কমিয়ে সার উৎপাদন করতে হবে। উৎপাদন না করে কেন আমদানিতে বড় আকারের অর্থ খরচ করা হচ্ছে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সারের যে মজুদ আছে তা দিয়ে হয়তো এই সিজন চলবে; কিন্তু সামনে রবি মৌসুম। তিন মাস পরেই বোরো মৌসুম আসছে। সরিষাসহ অন্যান্য আবাদ রয়েছে এ মৌসুমে। এখন যদি সার উৎপাদনে নজর না দিই বা বিদেশ থেকে আমদানি না করি বা সঠিক সময়ে যদি চাহিদা অনুযায়ী সার পাওয়া না যায় তাহলে উৎপাদন কমবে। দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটবে।
No comments