সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত কোন পথে? by রাশিম মোল্লা

২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি। নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। দীর্ঘ ১২ বছর পার হলেও এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। গত ৯ই সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু সেদিনও প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি র‌্যাব। পরে আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ই অক্টোবর নতুন দিন ধার্য করেছেন। তদন্তের নামে বার বার সময় ক্ষেপণ করায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ। দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন,  দীর্ঘ ১২ বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির মামলাটির তদন্তই শেষ হয়নি। বাংলাদেশে বহু ক্লুবিহীন হত্যা মামলার তদন্ত সম্পন্ন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ ও র‌্যাব এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ১১০ বার সময় নিয়েছে। আমরা সাংবাদিক সমাজ মনে করি তদন্তে তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের আন্তরিকতা ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাগর-রুনির মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ে শেষ করতে অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তভার দিতে পারে।     

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইমলাম মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবের কাছে। কিন্তু র‌্যাব এখনো তদন্তটি সম্পন্ন করতে পারেনি। যার কারণে এখন পর্যন্ত মামলাটির বিচার কার্যক্রমও শুরু করতে পারেনি। এই অবস্থায় মামলাটির তদন্তভারের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে অন্য কোনো সংস্থাকে দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানাই।    

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, বিগত সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছার অভাবেই সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত এখনো সম্পন্ন হয়নি। আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি এই মামলায় অনেক রাঘব বোয়াল জড়িত। যে কারণে তদন্ত সম্পন্ন না করে সময় ক্ষেপণ করেছে। বার বার সময় নিয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাটির তদন্ত সম্পন্ন করতে অন্য কোনো সংস্থার উপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হোক।       

আইনজ্ঞদের মতে, আইনে ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে। তবে এটি নির্দেশনামূলক, বাধ্যতামূলক নয়। এই সুযোগেই বছরের পর বছর সময় নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী একটি হত্যা মামলা ১২০ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা বলা হয়েছে। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। যে কারণে একটি মামলার তদন্ত শেষ করতে বছরের পর বছর সময় পান তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে ৩৮ ডিএলআর ১৫২ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে সাবেক এই জেলা জজ মানবজমিনকে বলেন, তদন্ত শেষ করার সময়সীমা এজাহার প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আর দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ বা সহকারী দায়রা জজ বিচারের জন্য মোকদ্দমাপ্রাপ্ত হওয়ার ৩৬০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু ১২ বছরেও সাংবাদিক দম্পতির তদন্ত শেষ হয়নি, সেহেতু এখন এই মামলাটির তদন্ত শেষ করতে অন্য কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করি। সাংবাদিক হত্যার বিচারহীনতার কালচার থেকে বের হওয়া না গেলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় অনীহা তৈরি হবে।

সূত্র জানায়, প্রথমে এ হত্যা মামলাটির তদন্ত শেরে-বাংলা নগর থানা পুলিশ শুরু করে। এসআই মো. জহুরুল ইসলাম মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বাদী ও সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারি নিহতদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন শেরে-বাংলা নগর থানায় গৃহীত হয়। তদন্তকারী অফিসারের প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পায় যে, অজ্ঞাতনামা আসামিরা ঘটনায় বর্ণিত সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যায়। চারদিন পর ১৫ই ফেব্রুয়ারি মামলাটি ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারি ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে পরিদর্শক মো. রবিউল আলম মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তদন্তকালে তিনি পুনরায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদপূর্বক সাক্ষীদের জবানবন্দি কাঃ বিঃ ১৬১ ধারা মতে রেকর্ডসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য জোর তৎপরতাসহ গুপ্তচর নিয়োগ করেন। অজ্ঞাতনামা আসামিরা ঘটনার বর্ণিত সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় নিহতদেরকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। এরপর ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল হাইকোর্ট তদন্তের ব্যর্থতায় র‌্যাবকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছে র‌্যাব। এই সময়ের মধ্যে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আদালতে মামলার ১০টি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.