গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ ও সংবিধান সংশোধন: প্রসাঙ্গিক ভাবনা by ড. মো. সফিকুল ইসলাম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন একটি আলোচিত বিষয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এটি একটি অত্যাবশকীয় দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বিভিন্ন সেমিনার, গোল টেবিল বৈঠক ও আলোচনা সভার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা ও বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। আমি মনে করি, সরকার ও এ ব্যাপারে সচেতন এবং সচেষ্ট। তবে যত দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া যায় ততই দেশের জন্য মঙ্গল। কেননা, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করবার জন্য সংবিধানকে তার দল ও পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের দলিলে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ভয়াবহ নিপীড়নমূলক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি, আক্রমণাত্মক বক্তব্য, মিথ্যা, প্রতারণা ও অপকৌশলের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ দান করেছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক এবং বিরোধী মতের লোকদেরকে গুম, খুন ও নির্যাতনের সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। এমতাবস্থায় অকুতোভয় ছাত্রদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়। এজন্য প্রায় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে জীবন দিতে হয়েছে যা দেশে-বিদেশে জুলাই ম্যাচাকার নামে পরিচিত। এ গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা হচ্ছে বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ যেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সেজন্য আওয়ামী সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানকে গণতান্ত্রিকীকরণ ও জনআকাঙক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা প্রয়োজন। যাহোক, সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন কোন বিষয়গুলো প্রথমেই বিবেচনায় নেওয়া উচিত সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি।

আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরে হীন দলীয় স্বার্থে সংবিধানের পঞ্চদশ, ষোড়শ, সপ্তদশ সংশোধনীসমূহ সম্পাদন করেছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে নিয়েছিল। যাহোক, এর মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। এ সংশোধনী সবচেয়ে বিতর্কিত, গণতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। বিশেষ করে, এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টির বেশী অনুচ্ছেদকে, যার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙ্গানোর বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত, সংশোধনের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে জাতীয় সংসদকে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিফলন। একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। অথচ পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের একটি বড় অংশ সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সার্বভৌমত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে যা অসাংবিধানিক। এটি মানবাধিকারের পরিপন্থি। কেননা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে চাইতে পারে। এটি কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। এছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী: “(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়” (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে” তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। (২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত” (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে” তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।” এই অনুচ্ছেদ পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধানের ৬(১) অনুচ্ছেদেরই অনেকটা প্রতিস্থাপন। পাকিস্তানের এ সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ”যদি কোনো ব্যক্তি সংবিধানকে ক্ষমতাবলে বাতিল করে, পরিবর্তন করে, অথবা জোর করে বা শক্তি প্রদর্শন করে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করে, সে ব্যক্তি চরম দেশদ্রোহীতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (২) কোনো ব্যক্তি (১) ধারায় উল্লিখিত কার্যক্রমের সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলে, সে ব্যক্তি ও একইভাবে চরম দেশদ্রোহীতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (৩) সংসদ আইনের মাধ্যমে চরম দেশদ্রোহীদের শাস্তি নির্ধারণ করবে।” কিন্তু, ১৯৭৩ সালের সংবিধান রচনার পর পাকিস্তানে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউল হকের মৃত্যুদণ্ড হয়নি। বরং মৃত্যুদণ্ড হয়েছে সংবিধান প্রণয়নকারী জনাব ভুট্টোর। নিয়তির কী পরিহাস! সুতরাং দেখা যায়, কঠোর শাস্তির বিধান করে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঠেকানো যায় না। একইভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বে জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান ছিল। জাতীয় সংসদের সদস্যগণ স্বপদে বহাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী করার বিধান নজিরবিহীন। এতে নির্বাচনে যেসব প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য নয় তারা বৈষম্যের স্বীকার হয়। সুতরাং, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জরুরি ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল বা সংশোধন করা উচিত।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে। কিন্তু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় তখন ও প্রকাশিতই হয়নি। সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত আদেশে আদালত বলেছিলেন: ”(১) সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ভবিষ্যতের জন্য বাতিল ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হলো। (২) যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন ‘এ সকল সনাতন তত্ত্বের¡র ভিত্তিতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বে উল্লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।” অন্যভাবে বলা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ‘প্রসপেকটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য অবৈধ ঘোষণা করে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে এটি আরও দুই টার্ম রাখার পক্ষে সর্বোচ্চ আদালত মত প্রকাশ করেছেন। তাই আদালতের এ রায়ের অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া দুরূহ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাতিল আমাদেরকে এক ভয়াবহ সংকটে মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের এবং দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়’ জনগণের এমন ধারণারই ফসল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির নেই বললেই চলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা চলে। আওয়ামী লীগ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি ও অগণতান্ত্রিক অভিযোগ তুলে বাতিল করলেও তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের উদাহরণ তো সৃষ্টি করতে পারেইনি বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশী কলুষিত করেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের এ তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশে ইতিহাসে সবচেয়ে জাল-জালাতিপূর্ণ ছিল। যাহোক, এ ব্যবস্থার যে সব ত্রুটিবিচ্যুতি সে সময়কালে দৃশ্যমান হচ্ছিল রাজনৈতিক দলগুলো তারা প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ না করে, উল্টো এর ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে দলীয় স্বার্থ হাসিল করার প্রতিযোগিতার কারণে এ ব্যবস্থাটির যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন তোলার পরিবেশ তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কিছু লোকের বক্তব্য ছিল নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। তাই শুধু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করলেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের অধীনে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশনকে সরকারি দলের অঘোষিত নির্দেশনা মেনে কাজ করতে হয়। এর ফলে নির্বাচন পক্ষপাতমুক্ত হয় না। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা। কিন্তু, বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিকরণ (ওহংঃরঃঁঃরড়হধষরুধঃরড়হ) হয়নি। প্রতিষ্ঠানসমূহ আইন ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব স্বাধীন ও যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম নয়। তাদেরকে সরকারি দলের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হয়। তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিতকরণ ও বরখাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের ক্ষমতার পরিধির মধ্যে আইন ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি দলের অনুকূলে কাজ করা স্বাভাবিক রীতিতে বা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই সরকারি দলের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সকল দল ও প্রার্থীদের জন্য লেবেল প্রেলিং ফিল্ড (খবনবষ চষধুরহম ঋরবষফ) তৈরি হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সুবিধা হলো এর নির্দলীয় চরিত্র। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাগণ দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তিত্ব না হওয়ায় তারা কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করেন না। তাদের কাছে সব দলই সমান। সব দলের প্রতি এ সরকার সমান আচরণ করতে পারে। নির্বাচনি প্রচারণা, নির্বাচনি আচরণবিধি এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজগুলো এ সরকার পক্ষপাতিত্ব পরিহার করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে পারে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সরকারের অধীনে স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। তাই আমার প্রস্তাব হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবিধানে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে সময়োপযোগী করতে হবে। যেহেতু অতীতে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসর প্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হওয়ার বিধান থাকায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সে কারণে উচ্চ আদালতকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের বিজ্ঞ/বিশিষ্ট ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগ করার বিধান করা যেতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে সরকারের কাজের পরিধি ও মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই উপদেষ্টাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ বজায় রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি “সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং “সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র” বাদ দিয়ে শুধু সমাজতন্ত্র যুক্ত করা হয়। কিন্তু, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্ধারিত সংবিধানের মূলনীতিসমূহ অনেক বেশী অর্থপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সংহতি পূর্ণ। তাই পঞ্চদশ সংশোধনী সংশোধন করে সংবিধানের পূর্বের মূলনীতি বহাল রাখা যুক্তিযুক্ত। আইন উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে জানা যায় যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং ’সাংবিধানিক সংস্কার’ কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিধান সংবিধানে অন্তভর্’ক্তকরণ এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। কেননা এ সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করলে ও পরবর্তীতে নির্বাচিত আইনসভার অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি) ইতোমধ্যে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করে এ বিষয়েসমূহে তাদের প্রতিশ্রুতিুতি ব্যক্ত করেছে। তারপর ও আমি মনে করি এ সরকার বি.এন.পি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্বান্ত নিলে এর একটি স্থায়ী সমাধান হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.