গরুর বাজারে স্কুল, স্কুলের জায়গায় কলেজ, জোরজবরদস্তিতে নামকরণ by জাবেদ রহিম বিজন

নিজের গাঁটের টাকা বা জায়গা  কোনোটাই দিতে হয়নি। জোরে-জব্বরে, মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে নামকরণ করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়ার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এরমধ্যে আখাউড়ায় গরুর বাজারের জায়গা দখল করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। যার উদ্যোক্তা স্থানীয় সাবেক মেয়র তাকজিল খলিফা কাজল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা-মায়ের নামে। আর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের নাম ঝুলিয়েছেন কাজল।

১৯৬৪ সালের ১লা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত আখাউড়া নাছরীন নবী স্কুল। মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) নূরুন নবী ও তার স্ত্রী নাছরীনের নাম মিলিয়ে ‘নাছরীন নবী’- নামকরণ হয়েছে। এলাকার তৎকালীন চেয়ারম্যান এম. তাহের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এই স্কুলের। এরপর ২০১১ সালে  বোর্ড থেকে স্কুলের সঙ্গে কলেজ  খোলার অনুমতি দেয়া হয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। ব্যবসায় শিক্ষা শাখা দিয়ে কলেজের কার্যক্রমও শুরু করা হয় তখন। পরে আরও বিষয় যোগ হয়। এরমধ্যে ২০১৮ সালে স্কুলের জায়গাতেই মন্ত্রীর মা’র নামে জাহানারা হক কলেজ খুলে বসেন সাবেক মেয়র কাজল। নাছরীন নবী স্কুল হিসেবেই থেকে যায়। ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে সরকার পতনের দিন পর্যন্ত এই বিদ্যালয় ও কলেজের সভাপতি ছিলেন কাজল। শুধু স্কুলের জায়গা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রীর মা’র নামে কলেজ করাই নয়, কাজল তার স্ত্রী তানিয়া আক্তারকে ওই কলেজের অধ্যক্ষও বানিয়েছেন অনিয়মে। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহা. শাহজাহান মিয়া মারা যান। এরপর কলেজের ১১জন প্রভাষককে ডিঙিয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদের স্ত্রীকে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসিয়ে দেন।

নাছরীন নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবব্রত বণিক পরিমল বলেন, ওই সময়ে কিছু বলা যায়নি। কিছু বললে হাত-পা কেটে ফেলবে। জিম্মি ছিলাম। তিনি জানান, স্কুলের মোট জায়গার পরিমাণ ২০১ শতাংশ। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ জায়গা কলেজের জন্যে লিখে নেয়া হয়। স্কুল ক্যাম্পাসের ভেতর ১০ শতাংশ আর বাকি ৬৫ শতাংশ আখাউড়া বাইপাস সড়কের পাশে নারায়ণপুরে। এলাকার জনগণের স্বার্থে জায়গা নেয়া হচ্ছে বলে রেজ্যুলেশন করা হয়। দানপত্র করে নেয়া হয় ওই জায়গা। এরপর কলেজ আলাদা করা হয়। এ নিয়ে তখন কথা বলতে পারিনি। তারপরও বোর্ড থেকে এসে নিয়মকানুন বলেছি। আলাদা করতে হলে জায়গা কিনতে হয় বলে জানিয়েছি। এসব শুনে সভাপতি (মেয়র) বলেছেন, ‘এখন দরকার নাই, পরে করবো। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী আছে কোনো সমস্যা নাই।’  

পৌর এলাকার কলেজপাড়ায় গরুর বাজারের জায়গা দখল করে প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্ত্রীর বাবার নামে সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। ৮ শতাংশ এই জায়গার মালিকানা নিয়ে আছে বিতর্ক। কেউ বলেন- গরুর বাজারের জায়গা। কেউ বলেন- অন্যের জায়গা জোরজব্বরে দখল করে স্কুল দেয়া হয়েছে। আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন জানান- গরুর বাজারের ৪১ শতক জায়গা পরিষদের নিজস্ব টাকায় কেনা। বাজারের পাশে আরেকটি দাগে থাকা জায়গায় স্কুলটি করা হয়েছে। তবে এই জায়গার মালিক কে তা বলতে পারবো না। তবে স্কুল করতে গিয়ে গরুর বাজারের  ৫/৭ ফুটের মতো জায়গা দখল করে নেয়া হয়েছে। এরপর বাজারের খালি জায়গায় বালি ভরাট করে স্কুলের ভবন করার চেষ্টা চালানো হয়। সে সময় অসংখ্যবার বাধা দিয়েছি। গরুর বাজারের জায়গার মালিকানা ইউনিয়ন পরিষদের হলেও পৌরসভা শুরু থেকে জোর করে সেটি ইজারা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান- তিনি। ইজারা থেকে বাৎসরিক পাওয়া ৩৬ লাখ টাকাও তারা নিচ্ছে। এ  থেকে তাদেরকে পাঁচটি টাকাও দেয়া হয় না। ভূমি ক্ষতিপূরণ বাবতও কোনো টাকা দেয়া হয় না। দেবগ্রামের ইয়াকুব মোল্লা জানান-যে জায়গায় স্কুল করা হয়েছে সেটি তার নামে। ৮ শতক পরিমাণ ওই জায়গার সাড়ে ৪ শতক দখল করে স্কুলটি করা হয়। এরপর তিনি, তার ভাইয়ের ছেলে শফিকুল ইসলাম খান ও ভাইয়ের স্ত্রী নূরজাহান বেগম ৩বার মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্কুল না করার অনুরোধ করেন। এ সময় মন্ত্রী তাদের বলেন, আমি পবিত্র ঠোঁটে বলছি আপনাদের জায়গায় স্কুল হবে না। তিনি আরও জানান জরিপে জায়গাটি গরুর বাজারের নামে রেকর্ড হয়। এ নিয়ে তারা আদালতে মামলা করেন। বিদ্যালয়টি করার পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল আউয়ালকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এই বিদ্যালয়ে। গত ১০ই সেপ্টেম্বর চাকরি ছেড়ে দেন আবদুল আউয়াল। তিনি বলেন, স্কুল পৌরসভার। তবে তাদের জায়গা কতটুকু জানি না।  পৌরসভা বিল্ডিং করার পর স্কুল চালু হয়। আমাকে অনুরোধ করে নেয়া হয়। আমি মাঝে একবার চাকরি ছেড়েও দিয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক কাজী ফারহানা ইতি ৪ দিন আগে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বলেন- স্কুল হওয়ার পর আমাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরপর থেকে ক্লাস করছি। জায়গার বিষয়ে পৌরসভা বলতে পারবে। আখাউড়ার আজমপুরের আমোদাবাদে বীর উত্তম সাফিল উদ্দিনের নামে করা স্কুলের নামও পরিবর্তন হয়েছে ১৯৯৭ সালে। পরে এ বিদ্যালয়টি তৎকালীন এমপি মো. শাহ আলমের নামে করা হয়। নামপ্রকাশ না করার অনুরোধে স্থানীয় বিশিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন- আইনত এসব করতে পারেন না। পরিচালনা কমিটি কলেজ করার জন্যে লিখে দিয়েছে। অরিজিনালি যারা গিফ্‌ট করেছেন তাদের জিনিস অন্য কেউ দিতে পারে না। মন্ত্রীর ক্ষমতা আছে বলে বাপের-মায়ের নামে করেছে। গরুর বাজারে স্কুল করেছে। কীভাবে এই জায়গা এলো। জায়গার দাতা কে। জায়গার মালিকানাই নেই। পানিয়ারুপ গ্রামে করেছে। আইনত এবং নৈতিকভাবে এটা করতে পারে না। আনিসুল হকের মতো লোক এমন করেছে এতে আমি লজ্জিত। বিতর্কিত জায়গায় যাওয়ার দরকার ছিল না।

কসবার বায়েক ইউনিয়নের সোনারবাংলা উচ্চ বিদ্যালয় এখন সোনারবাংলা সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। গত ২০/২২ বছর ধরে এমপিওভুক্ত হচ্ছিল না এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নাম পরিবর্তনের পরই মিলেছে বহু কাঙ্ক্ষিত এমপিও।  বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন জানান, ১৯৯৯ সালে সোনারবাংলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০/২২ বছর ধরে এমপিওভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হই। আমরা অনেক আবেদন করেছি। অবহেলিত ছিলাম। পরে এলাকার লোকজন মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তার বাবার নামে নামকরণ করার আবেদন জানান। এরপরই সোনারবাংলা এডভোকেট সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয় নাম করা হয়। মন্ত্রীর ডিও নিয়ে তখন বোর্ডে আবেদন করি। এজন্যে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে টাকাও দিয়েছে। বিদ্যালয়ে ৪টি ভবন হয়েছে। তবে জুনিয়র শাখা এমপিও হলেও সিনিয়র শাখা হয়নি।

পানিয়ারূপের একটি স্কুলের নাম পরিবর্তন হয়েছে ৪ বার। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল পানিয়ারূপ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৭০ সালে পানিয়ারূপ উচ্চ বিদ্যালয়। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ই আগস্ট থেকে বিদ্যালয়ের নাম মন্ত্রীর বাবা সিরাজুল হকের নামে করা হয়। সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের অক্টোবরে সিরাজুল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়। সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক ২০০৩ সাল থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম জানান- নামকরণের বিষয়টি কমিটি প্রস্তাব করেছে। এরপর রেজ্যুলেশন করে বোর্ডে পাঠানো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট জায়গা-জমির পরিমাণ ৩ একর ৩৮ শতক। এরমধ্যে দু’টি পুকুর আছে। বিদ্যালয়ের জন্যে জায়গা মন্ত্রীর পরিবারের দেয়া বলেই দাবি প্রধান শিক্ষকের। নামকরণের জন্যে ১৫ লাখ টাকাও মন্ত্রী দিয়েছেন। তবে এসব তথ্য দিতে প্রধান শিক্ষককে বাধা  দেন পরিচালনা কমিটির সদস্য জাজিসার গ্রামের আলী আশরাফ। কসবা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তৌহিদ বলেন- এক বছরের মতো আছি। আমার সময় কিছু হয়নি।   
কসবা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের অর্থে করা মহেশ ব্রিজের নাম পরিবর্তন করে এডভোকেট সিরাজুল হক সেতু করা হয়েছে। অবশ্য আগের টানা ব্রিজের স্থলে পাকা সেতু করার ব্যবস্থা করেন মন্ত্রী আনিসুল হক ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের অর্থ সহযোগিতায়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.