আলোচনা সভা: পোশাক খাতের অস্থিরতার নেপথ্যে তিন কারণ
গতকাল বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমই’র অডিটোরিয়ামে আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর চলমান সংকট ও উত্তরণের পথ নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে শ্রমিক অসন্তোষ তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন আশ্বাস দেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। সভায় সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াসহ পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা ও শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজিএমইএ’র সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।
শ্রমিক অসন্তোষের জন্য ৩ কারণ দায়ী উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, তবে সমাধান না হলে শিল্পের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে সেনাবাহিনী।
আর শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি। অনুষ্ঠানে পোশাক মালিকরা বলেছেন, সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ায় আগামীকাল (রোববার) সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে আগামী পরশু দিন থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, রোববার ঢাকার আশুলিয়ায় যে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে, সেই কারখানাই শ্রম আইন অনুযায়ী বন্ধ ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, রোববার (আজ) কারখানা চালু রাখা হবে। তখন যদি কোনো কারখানায় হামলা, ভাঙচুর হয়- শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে আশুলিয়ার কারখানা মালিকেরা কারখানা বন্ধ করে দেবেন।
রফিকুল ইসলামের এমন ঘোষণায় সমর্থন দিয়ে পোশাক নিট পোশাক কারখানা মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এই ঘোষণাকে সমর্থন দিলাম। ভাঙচুর হলে আশুলিয়ার কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে।
এদিকে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী সোমবারের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের সব বেতন ভাতা পরিশোধ করা হবে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড়ের জটিলতার কারণে কিছু কারখানা সঠিক সময়ে বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পারেনি। কাল ও পরশুর মধ্যে সকল বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।
মতবিনিময় সভায় যা হলো:
সভা শেষে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলামকে সমাপনী বক্তব্য দেয়ার জন্য আহ্বান করেন সঞ্চালক। এ সময় এ কে আজাদ বলেন, সভায় কোনো সিদ্ধান্ত তো হলো না। আমরা একটি ঘোষণা চাই, কারখানা খোলা রাখবো কিনা। তিনি কারখানা মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কি কারখানা খোলা রাখবেন নাকি বন্ধ করবেন? এই উপদেষ্টাদের তো আর পাওয়া যাবে না। তারা তো বারবার আসবেন না। এ সময় তিনি শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশুকে মঞ্চে ডাকেন বক্তব্য দেয়ার জন্য।
তখন মঞ্চে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ উপদেষ্টা উঠে দাঁড়ান এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন। বিজিএমইএ’র সভাপতি রফিকুল ইসলামকে বারবার কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণাটি জানিয়ে দেয়ার জন্য বলতে থাকেন এ কে আজাদ। এক পর্যায়ে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম ঘোষণা দিয়ে বলেন, আগামীকাল (রোববার) থেকে কোনো কারখানায় সমস্যা হলে রোববার থেকেই সারা দেশের সব শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
বিজিএমইএ সভাপতির ঘোষণা দিয়ে সরে গেলে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার আদিলুর রহমানকে মাইকের সামনে আসতে পীড়াপীড়ি করলে তারা দু’জনই চলে আসেন।
আবার মাইকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ কে আজাদ বলেন, শ্রমিকদের কথা শোনার জন্য একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কমিটি এক মাস সময় নিয়ে শ্রমিকদের কথা শুনবে। আমরা উপদেষ্টাদের কাছে শুনতে চাই এই এক মাস ফ্যাক্টরি চলবে কি চলবে না। এ কে আজাদ বলেন, সরকার দায়িত্ব নিলে কারখানা চালাবো, নইলে আগামীকাল (রোববার) থেকে সারা দেশে কারখানা অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা করবো। তিনি বলেন, বিজিএমইএ’র তথ্যানুযায়ী ২৭০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চললে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও অনেক কারখানা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ সরে যাচ্ছে। অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। এই মাসে কোনোভাবে বেতন দিতে পেরেছি। কিন্তু সামনের মাসে ৭৫ হাজার শ্রমিকের বেতন দিতে পারবো কিনা তা জানি না।
ততক্ষণে মাইকের কাছে দুই উপদেষ্টার পেছনে মঞ্চে থাকা উদ্যোক্তা, শ্রমিক নেতা ও বিজিএমইএ পর্ষদের সদস্যরা দাঁড়িয়ে যান। এরপর বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, এভাবে তো হবে না। শ্রমিক, মালিক ও সরকার সবাই মিলে শিল্প বাঁচাতে হবে। মালিক পক্ষকেও বলবো বেতনের সমস্যা সমাধান করতে।
তখন মাইক পুনরায় নিয়ে দুই উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে এ কে আজাদ বলেন, এবার আপনারা বলেন। এরপর শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, শ্রমিক প্রতিনিধিরা আছেন, তাদের কথা শুনতে চাই। এ সময় আশুলিয়ার এক শ্রমিক নেতাকে মাইকের সামনে আসার আহ্বান জানান তিনি। ওই শ্রমিক নেতা বলেন, আলোচনাই হলো সমাধানের মূল পথ। যত সমস্যা আছে আমরা এই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান করবো। কারখানা চালু থাকবে, আমরা সবাইকে সহযোগিতা করবো।
শ্রমিক নেতার বক্তব্য চলার সময়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান ও বিজিএমইএ নেতারা। শ্রমিক নেতার বক্তব্যের পরে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল আবার মাইকের সামনে এসে বলেন, ঘোষণায় একটু কারেকশন (সংশোধন) আছে। আগামীকাল আশুলিয়ায় কোনো কারখানায় সমস্যা হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হবে।
এরপর উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, কারখানা খোলা রাখাতে ৩ ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে সরকার। সরকার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সহায়তা করবে। এরপরও দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কেউ যদি সমস্যা করে তাহলে তাদের মনে রাখা হবে। আদিলুর বলেন, তৈরি পোশাক খাতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকার কমিটি করেছে। এই কমিটির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার যে সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে।
শ্রম ও কর্মস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম ও ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরি করে বলা হচ্ছে এখনই ভালো সময় ইনভেস্ট করার। এখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা কী করবো। শিল্প কী আমাদের এখানে থাকবে, নাকি অন্য শক্তি নিয়ে নেবে? বকেয়া বেতনকে মূল সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, এটাকে আগে অ্যাড্রেস করতে হবে। অনেক মালিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বেতন দেন না। সরকারের প্রণোদনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ আচরণ বদলাতে হবে। যেকোনো আন্দোলনে ষড়যন্ত্র সব সময়ই খোঁজা হয়। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে সময় মতো বেতন না দেয়া।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের অভিযোগ সমাধানে শ্রমসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সব অভিযোগ ও দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে শ্রমিকের আন্দোলনে একদমই যে ষড়যন্ত্র নেই, এমনও নয়।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ইতিমধ্যে শ্রমিকদের জন্য কোন প্রক্রিয়ায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্রম আইনের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার যতটা সুযোগ আছে, তা নিশ্চিত করবে সরকার। তবে এইসব প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হবে না।
শ্রমিকদেরকে সরকারের প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদেরকে সময় দিতেই হবে। আমরাও আন্দোলন করেছি, আপনাদের ন্যায্য দাবি যত দ্রুত সম্ভব সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই করবো।
No comments