৩৮ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী শ্রীলঙ্কায়, চমক দেখাবেন অনুরা দিশানায়েকে!

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৮ জনের বিশাল সংখ্যক প্রার্থী। তার মধ্যে আছেন দেশটির রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করে থাকা রাজাপাকসে পরিবারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসের বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসে, আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট আর প্রেমাদাসার ছেলে সিজিত প্রেমাদাসা, দেশটির প্রথম এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট জেআর জয়বর্ধনের ভাতিজা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।  তবে তার মধ্যে বেশ আলোচনা হচ্ছে মার্কসিস্ট অনুরা দিশানায়েকে’কে নিয়ে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বা পার্লামেন্টে সংখ্যার বিচারে তার দল তেমন আলোচনায় ছিল না। তা সত্ত্বেও ভারত সরকার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সাধারণত এমনটা দেখা যায় না।  ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ওই আমন্ত্রণে তিনি নয়াদিল্লি সফর করেন। সাক্ষাৎ করেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং সিনিয়র কিছু কূটনীতিকের সঙ্গে। ভারতের ভূরাজনৈতিক সমীকরণে তিনি এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে অনলাইন আল জাজিরা দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

অনুরা দিশানায়েকের বয়স ৫৫ বছর। তিনি দেশটির সরকারে নেই। তিনি যে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দেন তার নাম ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। এমনকি তারা মৌলিক অর্থে বিরোধী দলও নয়। শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে তাদের আছে মাত্র তিনটি আসন। তারপরও তারা সেখানে চতুর্থ বৃহৎ শক্তি। তার দলকে মাঝে মধ্যেই দেখা গেছে ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চীনের খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু কয়েক মাস ধরে অনুরা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভিন্ন এক রকম কর্তৃত্ব উপভোগ করছেন। এর ফলে তিনি উদীয়মান একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এমনকি আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার ভারতও তাকে এমন স্বীকৃতি দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এসব কারণে শ্রীলঙ্কায় আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর শনিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শীর্ষ প্রার্থীদের মধ্যে বিস্ময়করভাবে উঠে এসেছেন দিশানায়েকে। কোনো কোনো জনমত জরিপে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পদে ৩৮ জন প্রার্থীর ভিড়ের মধ্যেও তিনি ফ্রন্টরানার হয়ে উঠতে পারেন।
উল্লিখিত হেভিওয়েট প্রার্থীদের ভিড়ে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তার নিজের দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি)। এই দলটিকে কখনোই জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার কাছাকাছি দেখা যায়নি এর আগে। তার নেতৃত্বাধীন মার্কসিস্টদের দু’বারের বিদ্রোহে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলেও এখন সেই রাষ্ট্রকে শাসন করতে চাইছেন দিশানায়েকে। এই দলটি এবং তাদের নেতৃত্বে এনপিপি জোটের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায় ২০২২ সালে। ওই সময় দেশটির অর্থনীতি ধসে পড়েছিল। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। তখনকার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে দেখা দেয় ভয়াবহ এক গণঅভ্যুত্থান। সিংহলি ভাষায় এর নাম ‘আরগ্যালয়’ বা সংগ্রাম। ওই আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন। তার ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসেও পদত্যাগে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে তারা জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দেয়ার আনুষ্ঠানিক দাবি করেনি। কিন্তু জেভিপি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা প্রতিদিন প্রতিবাদ বিক্ষোভ আয়োজন করে। কলম্বোর গ্যালে ফেসে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নেয়। আয়োজন করে সাধারণ ধর্মঘটের। রাজাপাকসে ভাইদের পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ায় দেশে ক্ষমতায় শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এটাই দেশে ব্যাপক পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিবর্তনের দাবি জোরালো করার পথ তৈরি হয়ে যায় দিশানায়েকে ও জেভিপি’র জন্য। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা এই দলটি বিশ্বাসযোগ্য ও বড় একটি রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে। দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আপিল তার দলের মধ্যেও প্রতিধ্বনি তোলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক গামিনি ভিয়ান্যগোদা তার সম্পর্কে বলেছেন, সার্বিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে তার উদ্যোগকে সততা হিসেবে দেখেছি। যখন তিনি বলেন- দুর্নীতির দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন আমি তার এই কথাকে বিশ্বাস করি। তিনি সেটা করতে পারুন বা না পারুন সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু এই নিখুঁত মানসিকতা আমি অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে দেখিনি।
অনুরা দিশানায়েকের জন্ম শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরের অনুরাধাপুরা জেলার থাম্বতেগামা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ইউনিভার্সিটি অব কেলানিয়্যা থেকে তিনি বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি জেভিপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। ২০০০ সালে প্রথমবার তিনি পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে জেভিপি দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ করা হয় দিশানায়েক’কে। তখন থেকে তিনি দলকে তার সহিংস অতীত থেকে ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালে এবং ১৯৮০’র দশকে এই দলটি মার্কসবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে জেভিপি সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। তারা তখনকার দুই প্রেসিডেন্ট জেআর জয়াবর্ধনে এবং আর প্রেমাদাসার শাসনকে সাম্রাজ্যবাদী এবং পুঁজিবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদেরকে উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এটাকে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত সময়ের অন্যতম একটি অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়। ওই সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়। রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয় মানুষ। অনানুষ্ঠানিক কারফিউ দেয়া হয়। স্যাবোটাজ করা হয়। জেভিপি ধর্মঘট আহ্বান করে। জেভিপি যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে তার মধ্যে ছিলেন বুদ্ধিজীবী, আর্টিস্ট, ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তা এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। এর জবাবে রাষ্ট্র নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয়। তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ এবং গণহত্যা চালিয়ে তাদেরকে দমন করে। সরকারি দমনপীড়নে নিহত হন কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে আছেন জেভিপি’র প্রতিষ্ঠাতা রোহানা বীজেউইরা সহ সিনিয়র কর্মকর্তারা। বিদ্রোহে ব্যর্থ হওয়ার পর জেভিপি’র পলিটব্যুরোতে নিয়োগ করা হয় অনুরা দিশানায়েককে। ওই সময় দলটি সহিংসতা ত্যাগ করে। তারা নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে। ২০১৪ সালের মে মাসে বিবিসিতে একটি সাক্ষাৎকারে দিশানায়েক দলের অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান। শ্রীলঙ্কার প্রথমদিকে ব্যাপকভাবে সহিংসতার জন্য এটাই প্রথম এবং এটাই জেভিপি’র সর্বশেষ ক্ষমা প্রার্থনা।
তিনি ক্ষমা চাওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার বাম ঘরানার কিছু নেতা এবং নিজ দলের কিছু নেতা সমালোচনা করেন দিশানায়েকের। তারপর থেকে তিনি অতীত নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে সতর্ক হয়েছেন। অনেকবার তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। তবে আর কখনোই তিনি ক্ষমা চাননি।
এখনো অতীত জেভিপি এবং দেশকে তাড়া করে ফেরে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ১৯৮০’র দশকে জেভিপি’র বিদ্রোহের সময় প্রেমাদাসা সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন। সেই সরকারের দমনপীড়নে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে এখনো তাকে অভিযোগ শুনতে হয়। অন্যদিকে শ্রীলঙ্গার প্রবীণদের অনেকেই জেভিপি’র সন্ত্রাসী অতীত ভুলে যাননি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.