বর্তমানের পথভ্রষ্ট সাংবাদিকতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে একজন নাজিমুদ্দিন মোস্তানকে আজ বড়ই প্রয়োজন by হুমায়ুন কবির বুলবুল

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন কিংবা রাজনৈতিক দলের বিশাল কোনো কর্মসূচি। সাংবাদিকদের বসার জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সকল মিডিয়ার সাংবাদিকরা রয়েছে সেখানে। কিন্তু সবচেয়ে বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের কোনো সাংবাদিক নেই প্রেস গ্যালারিতে!

আয়োজকরা প্রথমে কিছুটা বিস্মিতই হয়েছেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, সবার পেছনে চুপচাপ বসে মনোযোগ সহকারে নোট নিচ্ছেন একজন সাংবাদিক। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকেই প্রকাশিত হলো সবচেয়ে তথ্যবহুল সংবাদ। আর এই কাজটির জন্য যার মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা কাজ করেছে, তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের কিংবদন্তি নাজিমুদ্দিন মোস্তান।
‘শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস’ সিরিজ রিপোর্টিংয়ের গাইড লাইন দিয়েছিলেন নাজিমুদ্দিন মোস্তান। ১৯৮৬-১৯৯২ পর্যন্ত আমি দৈনিক ইত্তেফাকের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ছিলাম। তখন বাংলাদেশে ছিল মাত্র ৫টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। স্বৈরশাসনের কালো থাবায় তখন সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস।

এক পর্যায়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের ওপর সিরিজ রিপোর্টিং করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তৎকালীন বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার অনুমোদনও দিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমার একটা গাইড লাইন দরকার ছিল। মোস্তান ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। হাতের কাজ শেষ করে আমাকে নিয়ে বসলেন। দীর্ঘ আলাপচারিতায় দিলেন একটা চমৎকার গাইড লাইন। মোস্তান ভাইয়ের দিকনির্দেশনায় সম্পন্ন সেই সিরিজ রিপোর্ট ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। যেখানেই ইত্তেফাকের সার্কুলেশন কমে যেত, সেখানেই নাজিমুদ্দিন মোস্তান।
আশির দশকের শেষদিকে প্রকাশিত হয় দৈনিক ইনকিলাব। হঠাৎ করেই ইত্তেফাকের একটা প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়, যদিও সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তারপর পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটা দৈনিক বাজারে আসে। তখন কোনো কোনো জেলায় ইত্তেফাকের সার্কুলেশন পড়ে যেতে থাকে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, ঐ সব জেলা থেকে সরজমিন ধারাবাহিক রিপোর্ট করবেন নাজিমুদ্দিন মোস্তান। যেই কথা সেই কাজ। অন্তত মাসখানেকের জন্য ঐ জেলায় ঘাঁটি গাড়লেন নাজিমুদ্দিন মোস্তান। প্রতিদিন ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতে থাকলো ব্যতিক্রমী সব রিপোর্ট। আর প্রতিদিনই বাড়তে থাকলো সার্কুলেশন। নাজিমুদ্দিন মোস্তানের উপস্থিতিতেই প্রচার সংখ্যায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেল ইত্তেফাক।

সাপ্তাহিক রাষ্ট্র: ছোট কাগজ কিন্তু ব্যাপ্তি বহুদূর: নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক রাষ্ট্র। সচরাচর ৮ পৃষ্ঠার সাদাকালো কাগজই বেরুতো। তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ছিল না। কিন্তু সাপ্তাহিক রাষ্ট্র এমন ব্যতিক্রমী ও তথ্যবহুল কাগজ ছিল যে, অল্পদিনের মধ্যে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়ও সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’র ছিল ব্যাপক কদর। সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতো, হয়তো পরবর্তী সংখ্যায় আসছে ব্যতিক্রমী তথ্যসমৃদ্ধ বিশেষ কোনো রিপোর্ট। ছোট কাগজ কিন্তু তার ব্যাপ্তি ছিল বহুদূর।

সজ্জন, মৃদুভাষী ও নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন নাজিমুদ্দিন মোস্তান। তিনি এত বড় মাপের সাংবাদিক ছিলেন, কিন্তু সচরাচর নিজের পরিচয় দিতেন না। বিত্ত-বৈভবের দিকে নজর ছিল না তার কোনোদিন। খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। বাংলাদেশের মিডিয়াকে তিনি যা দিয়ে গেছেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বর্তমানের পথভ্রষ্ট সাংবাদিকতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য একজন নাজিমুদ্দিন মোস্তানকে আজ বড়ই প্রয়োজন।

[লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। দৈনিক ইত্তেফাক ও The New Nation পত্রিকার প্রাক্তন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সাবেক সুপ্রিম কোর্ট রিপোর্টার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য]

No comments

Powered by Blogger.