বিপ্লব কেন ব্যর্থ হয়? by মতিউর রহমান চৌধুরী
কিন্তু অল্পতেই মানুষ বিগড়ে যায়। আরব বিশ্বের উদাহরণ তাই। তিউনিশিয়া ও মিশরের শাসকদের পতন হলেও প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। তিউনিশিয়ার বিপ্লব একটি দুর্বল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। যা এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মিশরে অল্পদিন পরেই সেনাশাসন ফিরে আসে। ভেঙে খান খান হয়ে যায় বিপ্লবের আশাগুলো। বিপ্লবের সাফল্য একটি কঠিন পথ। বাংলাদেশেও একই ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে চলেছে। স্থিতিশীল শাসন না হলে মানুষ নানাভাবে অঙ্ক মেলাতে শুরু করবে। বিপ্লব সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর মিলন ঘটিয়ে থাকে। যারা পরিবর্তনের জন্য একতাবদ্ধ হয়। শক্তিশালী শাসকদের চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। বিপ্লব ব্যর্থ করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে গুজব। ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে। যেমনটা বিরামহীনভাবে চলছে বাংলাদেশে। এক কোটি হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এই গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। এই কার্ড খেলার পেছনে একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম অনবরত মিথ্যা প্রচার করে বিভাজন উস্কে দিচ্ছে।
উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়াই একমাত্র দেশ যার উত্তরণ ঘটেছে অনেক নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে। ২০১০ সনের ১৭ই ডিসেম্বর বিদ্রোহের জন্ম। রাস্তার এক ফলবিক্রেতা যুবকের কাছে ঘুষ চেয়ে পুলিশ তাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। সরকারি দুর্নীতি আর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কারণ লোকেরা চাকরি, উন্নত জীবনযাত্রা এবং বৃহত্তর স্বাধীনতা দাবি করেছিল। এই ঘটনার পর তিউনিশিয়ার পুলিশ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলীর সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অনাস্থা বাড়তেই থাকে। ২০১১ সনের ১৪ই জানুয়ারি বেন আলী তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তিউনিশিয়ার সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু। হাসিনার পদত্যাগে শেষ। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এখানেও পুলিশ শত শত মানুষকে হত্যা করে। দেশি-বিদেশি নানা শক্তি তাকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়। নিজের দেশের লোকদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করায় মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। যা কিনা এই অঞ্চলে নজিরবিহীন। সফল বিপ্লবের পর দুই সপ্তাহ কেটেছে অনেক ষড়যন্ত্র আর চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে।
জুডিশিয়াল ক্যু-এর চেষ্টা ছিল অন্যতম। কিছু কিছু ঘটনা বিপ্লবের কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করে তুলছে। আশার কথা, ঘটনার পর দায় স্বীকার করা হচ্ছে। যেটা আগে হতো না। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমাত্র আশার প্রতীক। তাকে ঘিরেই এখন বিপ্লব পরবর্তী সংস্কারের দিকে এগুচ্ছে দেশ। যদিও সর্বক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। নড়বড়ে এবং ভঙ্গুর পরিস্থিতি সবখানে। শেখ হাসিনার প্রশাসন দিয়ে ইউনূসের শাসন যে চলতে পারে না এটা বোধ করি বিপ্লবের নায়কেরা বুঝতে পারছেন।
এই অবস্থায় রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি সঠিক রাজনীতি না করে তাহলে বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখা হয়তো কঠিন হবে। যেমনটা হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে। ল্যাতিন আমেরিকার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। কারণ সেখানকার বিপ্লব ছিল অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। ভেনিজুয়েলার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিপ্লবের পর অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনা করা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবের পর সামাজিক উত্তেজনা বাড়াটাই স্বাভাবিক। যা কিনা আরও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। বিপ্লবের জন্য একটি বড় হুমকি হলো- প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থান। যা পুরনো ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ঘটে। অনেকক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থানেও শেষ হয়। বাংলাদেশের পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এই বিপ্লবকে অবৈধ এবং বিশৃঙ্খলা বলে বর্ণনা করেছেন। মিথ্যা প্রচার বিভাজন সৃষ্টি করে। মানুষের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হয় । বিপ্লবকে দুর্বল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মনে রাখতে হবে- এসব কৌশল নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল করবে। এটা করার অন্যতম উদ্দেশ্য বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি করা। ১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লবে রাশিয়ার জার শাসনের অবসান ঘটে। সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার ইতিহাসে একটি বড় বাঁক নেয়। খাদ্য ঘাটতি, সামরিক ব্যর্থতা ও স্বৈরশাসনের কারণে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই বিক্ষোভ নতুন বিপ্লবে রূপ নেয়। জার নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন। তৈরি হয় শূন্যতা। নতুন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একইভাবে বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। পুলিশ কাজ করা থেকে বিরত থাকে। যেমনটা রাশিয়াতে হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগের অভাবে নিরাপত্তাহীনতা এবং ভয়ের সৃষ্টি হয়। যা জনগণের দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখার জন্য মানুষ সংগঠিত হয়। নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সাধারণত, বিপ্লবের পর সামাজিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। যার ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়। রাশিয়ার বিপ্লবের সময় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ হয়। ফলে ভয়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ঘটনা অবশ্য ঘটে। যদিও বেশির ভাগ ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক সমর্থকদের দ্বারা উত্তেজনা সৃষ্টিই ছিল মূল লক্ষ্য। কর্মকর্তাদের ব্যাপক পদত্যাগ সরকারকে দুর্বল করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ রাশিয়ার সরকারের পদত্যাগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করে। রাশিয়ার পুলিশ ও বিচারবিভাগের পতনের ফলে পেট্রোগ্রাদে নিয়ন্ত্রণের অভাব হয়। যা জনগণের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়ায় সরকার ব্যর্থ হওয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে। তারা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যাতে করে জনগণের অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও চরমপন্থিরা বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা লাভ করতে পারে। যেমনটা রাশিয়ায় বিপ্লবী চরমপন্থিরা করেছিল। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বিপ্লবের সাফল্য ও ব্যর্থতা শিখিয়েছে জনগণের সঙ্গে স্বচ্ছভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা না গেলে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি না করলে বিপ্লব লাইনচ্যুত হতে পারে। জনগণকে সঠিক তথ্য এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখাই হচ্ছে প্রধান কাজ। বিপ্লবের চূড়ান্ত পরীক্ষা হচ্ছে নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু করা। ল্যাতিন আমেরিকার বিপ্লবী সরকারগুলোর মতো বাংলাদেশের সরকারকেও বিপ্লবী আদর্শ রক্ষা করা হবে অন্যতম কাজ। শাসনের বাস্তব প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা সব মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য সহায়ক হচ্ছে কিনা সেটাও সার্বক্ষণিক পর্যালোচনার দরকার। বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখার অনেকটাই নির্ভর করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর। তারা এই বিপ্লবের চালিকা শক্তি। তাদের কথা বলার সময় অধিক মাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে। আমরা সবাই জানি অতি প্রচার নয়া সংকটের জন্ম দেয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
দেশে দেশে বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর জোর দেয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। একনায়কতন্ত্র থেকে সাবধান থাকা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা। তিউনিশিয়ার নবজাত গণতন্ত্র বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামপন্থি উভয় দলগুলোর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি করে। ২০১৩ সালে উত্তেজনা চরম বৃদ্ধি পায়। এ সময় দুই বিশিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ চোকরি বেলাইদ ও মোহাম্মদ ব্রাম্মীকে হত্যা করা হয়। দেশটি তখন রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। আর তখনই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
No comments