আবু সাঈদ হত্যার তদন্ত নিয়ে সংশয় by জাভেদ ইকবাল

আবু সাঈদ। কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগী রংপুরের এই শিক্ষার্থী। যার রক্তের বিনিময়ে এসেছে নতুন স্বাধীনতা। ন্যায্য দাবি আদায়ে বেরোবি’র বিপ্লবী শিক্ষার্থী। বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তার নিহতের ঘটনায়  বারুদ জ্বলে উঠেছিল সারা দেশের ছাত্র-জনতার বুকে। অসহযোগ আন্দোলনে পতন হয়েছে শেখ হাসিনার সাম্রাজ্যের। সূচনা হয়েছে নতুন এক ইতিহাসের। সেই মহানায়কের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

মৃত্যুর এক মাসেও আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে হয়নি কোনো মামলা। পুলিশের করা তাজহাট থানার আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের অংশে তদন্ত করছে পিবিআই। তবে কোটা আন্দোলনের সময় দায়ের করা পুলিশের মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। ঘোষণা অনুাযায়ী তাজহাট থানার মামলাটি প্রত্যাহার হলে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবিলম্বে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা, তদন্তের জন্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

আবু সাঈদ হত্যায় সুনির্দিষ্ট মামলা হয়নি: গত ১৬ই জুলাই আন্দোলনে বেরোবি শিক্ষার্থী ও পুলিশের সংঘর্ষে নিরস্ত্র আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। পরদিন ১৭ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায় পরস্পর যোগসাজশে বেআইনি জনতাবদ্ধে সাধারণ ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধার সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যার অপরাধে মেট্রোপলিটন তাজহাট থানায় মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় অজ্ঞতানামা উচ্ছৃঙ্খল দুই থেকে তিন হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তসহ বিএনপি, জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীকে। মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়‘ বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে একজন শিক্ষার্থী রাস্তায় পড়ে যায়। তখন সহপাঠীরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। সেইসঙ্গে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা আবু সাঈদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলায় মাহিম নামে এক নাবালক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ। দু’সপ্তাহ জেল খাটার পর আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি পায় ওই কিশোর। এদিকে গত ৩রা আগস্ট আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় অপেশাদার আচরণের অভিযোগে এএসআই আমীর হোসেন ও তাজহাট থানার কনস্টেবল সুজন চন্দ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত ১২ই আগস্ট তাজহাট থানার মামলার আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের অংশটির তদন্তের ভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), রংপুর। পরদিন আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সময় দায়িত্বে থাকা রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।  

আবু সাঈদ হত্যার বিচার নিয়ে সংশয়: গত ১৪ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে জানান, কোটা পদ্ধতি সংস্কার ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারা দেশে পুলিশের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা আগামী ৩১শে আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে। এতে করে পুলিশের করা তাজহাট থানার মামলাটি প্রত্যাহার হলে আবু সাঈদের হত্যার ঘটনায় আর কোনো মামলা থাকবে না। সচেতনদের মতে, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা না হওয়ায় এটির সঠিক বিচার নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পুলিশের দায়ের করা মামলা, পুলিশের একটি বিভাগ তদন্ত করায় এটির সঠিক তদন্ত নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবু সাঈদের হত্যার ঘটনায় মামলা না হলে তৃতীয় পক্ষ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করে বিভিন্ন মহলকে মামলায় জড়ানোর হুমকি নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।

পিবিআই যা বলছে: আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে পিবিআই রংপুর অফিসের এসআই জিল্লুর রহমান মামলাটি তদন্ত শুরু করেছেন। পিবিআই বলছে, আইন উপদেষ্টার নির্দেশে পুলিশের করা মামলাগুলো খারিজ হলেও আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলাটি থেকে যাবে। পিবিআই রংপুরের পুলিশ সুপার এবিএম জাকির হোসেন বলেন, আবু সাঈদের পরিবার কিংবা অন্য কোনো পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। যদি বিজ্ঞ আদালত কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মামলা হয় তবে আমরা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তদন্ত করবো। তবে তাজহাট থানায় দায়ের করা মামলার আবু সাঈদের অংশের তদন্ত ভার পেয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি।

আবু সাঈদ হত্যার বিচারে সোচ্চার শিক্ষার্থীরা: গত ১৪ই আগস্ট থেকে চার দফা দাবিতে ‘প্রতিরোধ সপ্তাহ’ পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রতিদিনের কর্মসূচিতে আবু সাঈদসহ কোটা আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের সঠিক বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। ৪ দফা দাবি আদায়সহ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র মনিরুজ্জামান বলেন, দেশবাসী দেখেছে আবু সাঈদকে কীভাবে পুলিশ লীগ গুলি করে হত্যা করেছে। শিক্ষার্থী তাসিন বলেন, আবু সাঈদ ভাইয়ের মৃত্যু স্বৈরাচার সরকার হটাও বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর দাবি জানাচ্ছি যেন আবু সাঈদ ভাইয়ের পরিবার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি মামলা দায়ের করে। এরপরেও কেউ মামলা করতে এগিয়ে না আসলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে আবু সাঈদ হত্যা মামলা দায়ের করে খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.