সরকারকে স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে -সেমিনারে বক্তারা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপ্লবী সরকার আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, বর্তমান সরকার রক্তাক্ত মঞ্চ থেকে তৈরি হয়েছে। শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে। এই সরকার, এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। তাই বর্তমান সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। গতকাল জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদ (এনসিপিটি) আয়োজিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া   হলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনপ্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।

এতে স্বাগত বক্তব্য দেন এনসিপিটির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন। তিনি বলেন, গত ১৭ বছরে স্বৈরাচারী শাসনের নিষ্পেষণে এ দেশের মানুষ যখন দমবন্ধ অবস্থায় ছিল তখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আমরা মুক্তি পেলাম। এই ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসন নিপীড়ন, গুম, খুন যেমন একদিকে জনগণকে নিষ্পেষিত করেছে অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটতরাজ, চুরি, অর্থপাচার দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছে। অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পালানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, বিধ্বস্ত এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করায় তার সামনে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জনগণেরও আশা-আকাক্সক্ষা তাকে ঘিরে অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে রয়েছে বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। যেখানে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যেখানে থাকবে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ। যেখানে মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, একটা প্রচণ্ড রক্তাক্ত মঞ্চ থেকে এই সরকার তৈরি হয়েছে। সেই মঞ্চ ও আপামর জনগণের কিছু দাবি ছিল। গত ১৫-১৬ বছর ধরে এই দাবিগুলো উত্থাপিত হয়েছে। সেই দাবি থেকেই এই সরকারের কর্মকাণ্ডগুলো প্রায়োরিটি পাবে। যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন তাদের স্বীকৃতি সবার আগে দিতে হবে। এটা অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। যারা আহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে। এটাও হচ্ছে না। আহতদেরও স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা না করলে এই বিপ্লবের সত্যিকার ইতিহাস তৈরি হবে না। তিনি বলেন, একটা ফ্যাসিবাদের প্রেক্ষাপটে শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ঠিক না করলে এই ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে। আমরা আর রক্ত দিতে চাই না। এই সরকার, এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মেজবাহ-উল আজম সওদাগর বলেন, সারা দেশের মানুষ সাক্ষী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি সরকার, সরকারপ্রধান ও তার সকল বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধ ঘোষণার পর সেই বাহিনী পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সম্পূর্ণ ক্যাবিনেট পালিয়েছে। এই অবস্থায় যে সরকার গঠিত হলো তার ন্যাচার কী হবে। এই সরকার কি নিরপেক্ষ হবে নাকি যারা বিপ্লব সাধিত করেছে তাদের ইচ্ছায়, তাদের অংশগ্রহণে এই সরকার পরিচালিত হবে। এটিই এই মুহূর্তে বড় প্রশ্ন। এই উত্তর না পাওয়ায় আমাদের মাঝে প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা, ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হলে আমরা নিরপেক্ষতা খুঁজতাম। কিন্তু এখানে একটা শক্তি পরাজিত। একটা পরাজিত শক্তিকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা কেন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বর্তমান সরকারকে। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রত্যেকটা হাসপাতালে চোখ হারানো, হাত-পা হারানো অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ মানুষ কাতরাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো দেখি নাই সরকার থেকে সেখানে বিশেষ কোনো সহায়তা এসেছে বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি এসবের ব্যবস্থা নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট করা যায়, কীভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে এই বিষয়গুলো সরকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. সফিকুল ইসলাম বলন, এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার না করলে স্বচ্ছ, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। একটা জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। পুলিশ প্রসাশন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সরকারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক ফজল বলেন, এই সরকারের ইমিডিয়েট কাজ হচ্ছে, সংবিধানের ষষ্ঠদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করা। এটি বাতিল ঘোষণা করলে আমরা মোটামুটি সহ অবস্থায় ফিরতে পারবো। এই সরকারের তিন ধরনের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কাজগুলো খুব সাধারণ কাজ। এগুলো কোনো রাজনৈতিক দল বাধা দিবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো, ভোটের অধিকার, পরিবেশ, বাস্তবতা নিশ্চিত করা।
সভাপতির বক্তব্যে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, এটা নামে অন্তর্বর্তী সরকার বললেও এর ক্যারেক্টার হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের মতো। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে ওই বিপ্লবের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা। সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ না করলে তা ধীরে ধীরে কচ্ছপের মতো মাথা বের করবে, আবার লুকাবে, আবার মাথা বের করবে। তাই এই জাতিকে যদি আমরা নিরাপদ রাখতে চাই তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী, ফ্যাসিবাদী শক্তিকে কোনোক্রমেই অধিকার দেয়া যাবে না। আমাদের রাষ্ট্র এক আজব রাষ্ট্র। আমরা শত দলে বিভক্ত। আমাদের এই বিভেদ হলো আর্টিফেশিয়াল। আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.