সাকিব, এবার প্রশ্নটা নিজেকে করেন by সৌরভ কুমার দাস

২০১৯ সালে তামিম ইকবাল, ২০২৪ সালে সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের সাবেক দুই অধিনায়কের একই প্রশ্ন, 'দেশের জন্য কি করেছেন?' প্রশ্নটা তামিম করেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে আর সাকিব করলেন গ্যালারিতে। কিন্তু প্রায় দেড় যুগ বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেয়ার পর এখন দুজনের নিজেদের কি প্রশ্ন করা উচিত না যে, তারা দেশের জন্য ঠিক কি করেছেন।

সম্প্রতি কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি খেলতে যাওয়া সাকিব এক প্রবাসী দর্শকের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়ান। সেই দর্শককে তিনি এক পর্যায়ে প্রশ্ন করে বসেন, ‘আপনি দেশের জন্য কী করেছেন’? বারবার তিনি একই প্রশ্ন করতে থাকেন। সেই দর্শক তাকে ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে বলেন। জবাবে আরও রেগে গিয়ে সাকিব কর্তব্যরত পুলিশকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন বলেও দাবি সেই ভক্তের। আশেপাশের দর্শকরাও তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সাকিবের ওপর।

সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারে বিতর্কের অভাব নেই। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট তো বটেই, মাঠের বাইরেও তার কুকীর্তি নিয়ে আস্ত একটা বই লেখা যাবে। দেশের হয়ে ১৮ বছর ক্রিকেট খেলছেন, অথচ অর্জনের ভান্ডারে নেই একটা একটা এশিয়া কাপ ট্রফিও! বরং দিনের দিন নিয়ম ভেঙেছেন, উতরে গেছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। অথচ শৃঙ্খলাটাই হওয়ার কথা ছিল তার মানদণ্ড।

২০১১ বিশ্বকাপ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচের পর গ্যালারির দিকে মিডল ফিঙ্গার দেখান সাকিব। এই জঘন্য ঘটনাতেও তখন অধিনায়কের বিপক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে ব্রডকাস্টিং ক্যামেরায় গোপনাঙ্গ দেখিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও তিনিই করেছিলেন। পরের বছর সাকিবের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে মানবপাচারের। সেবারও সাকিবকে কোনো জেরার মুখে পড়তে হয়নি।

২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দারুণ পারফর্ম করেন সাকিব। বিশ্বজুড়ে সমাদৃতও হয়েছেন। ঠিক তার কয়েকদিন পরই আইসিসি তাকে নিষিদ্ধ করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও আইসিসিকে না জানানো। এই কাণ্ডে একবছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ মোট ২ বছর নিষিদ্ধ হন সাকিব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাকিব জুয়ারির সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ডিলেট করেন, আইসিসি সেটা উদ্ধার করতে না পারার কারণেই বড় শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পান সাকিব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৩ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর (তখন পর্যন্ত), একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে খেলার পর, সবমিলিয়ে সাত থেকে আটশ ম্যাচ খেলার পর একজন ক্রিকেটার কিভাবে অমন ভুল করেন? অথচ প্রতিটি টুর্নামেন্ট, সিরিজ শুরুর আগেই ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে বিশেষভাবে জানানো হয়। তারপরও সাকিব ভুল করলেন, কিন্তু পাশে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষকে। অথচ সেই সাকিবই সাধারণ দর্শককে প্রশ্ন করে বসেন!

তাহলে সাকিব দেশের জন্য কি করেছেন, তার আরও কিছু নমুনা দেখা যাক। সাতক্ষীরায় একটি কাঁকড়ার খামারের ব্যবসা ছিল সাকিব আল হাসানের। সেই কারখানা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা আছে। অনেকেই নানা সময়ে টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। তবে এই ব্যবসা আলচনায় আসে ২০২২ সালের এপ্রিলে, সাকিবের ফার্মে কাজ করা প্রায় ২০০ শ্রমিক চার মাসের বেতন না পেয়ে বিক্ষোভ করেন।

একই বছরের মে মাসে রংপুরে সরকার দলীয় এক নেতার সাথে সাকিবের খোলা প্রতিষ্ঠান "বুরাক কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ"- এর বিরুদ্ধে প্রতারনার অভিযোগ উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে শেয়ার বাজারে রেজিস্ট্রেশনে বাবার নামও ভুল লেখেন সাকিব। এটা নিয়েও সমালোচনা হয় অনেক।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে সাকিবের প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্টের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় শেয়ারবাজার ম্যানুপুলেশনে নাম আসে। ২০২৩ বিপিএলে বিপিএলের দল ফরচুন বরিশালের স্পন্সর ছিল মোনাক মার্ট, যে দলের অধিনায়কও ছিলেন সাকিব। কয়েক মাস পর এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই আবারো একই অভিযোগ আসে ম্যানুপুলেশনের।

গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে সতীর্থকে নিয়ে সাক্ষাৎকারে বিতর্কিত সব মন্তব্য করেন সাকিব। একই বছরে সাকিব আল হাসানের বোন জান্নাতুল ফেরদৌসের নাম আসে ভারতের বেটিং সাইট স্ক্যামের এক তদন্তে। ধারণা করা হয়, সাকিব নিজেই তার বোনের নাম ব্যবহার করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, সাকিবকে একটি ঘটনাতেও জবাবদিহিতা করতে হয়নি।

আরও একটা ঘটনা বলি, কয়েক মাস আগে দুবাইয়ে আরাভ খান নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দোকান উদ্বোধন করতে যান সাকিব। যে কিনা বাংলাদেশে খুনের মামলার আসামি, ইন্টারপোলেও মোস্ট ওয়ান্টেডের লিস্টে নাম আছে তার। ওই সফরে সাকিবের সঙ্গে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি তারকা গিয়েছিলেন। পরে প্রত্যেককে ডিবি অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়। কিন্তু একবারের জন্যও সাকিবকে কেউ জেরাও করেনন।

আর ক্রিকেটে তো সাকিবে যেন একচ্ছত্র অধিপতি। কোনো সিরিজে আগে সবার কৌতূহল থাকে তিনি খেলবেন কিনা! কয়েকদিন আগে এক নির্বাচক আলাপকালে বলছিলেন সাকিব খেলবেন কিনা সেটা তাদের হাতে থাকে না।

১৭ বছরের ক্যারিয়ার সাকিবের, গড়েছেন অসংখ্য ব্যক্তিগত রেকর্ড। একসঙ্গে তিন ফরম্যাটে অলরাউন্ডারদের শীর্ষে থাকার মতো বিরল রেকর্ডও আছে তার। এর মধ্যে নিজের জেনারেশনের সেরা অলরাউন্ডারের খেতাবও পেয়েছেন। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবেও আছে একাধিক রেকর্ড। নিঃসন্দেহে একজন কিংবদন্তী, কিন্তু যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশকে কি জিতিয়েছেন? তবে ইতিহাস আলো থেকে আঁধারেই ফিরে আসে

১৭ বছর হয়ে গেলো বাংলাদেশের হয়ে খেলছেন, তবে কি সেটা বিনামূল্যে? অবশ্যই না। মাসে বেতন নেন সবার চেয়ে বেশি। বছরে একটা টেস্ট খেলেও বেতন নেন তিন ফর‍্যমাটের! শুধু সাকিব নয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রায় সবাই মনে করে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে অনেক বড় কিছু করে ফেলেছেন। আদৌ কি তাই? ব্যাপারটা হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে খেলা।

তাও দর্শকরা তাদের মাথায় তুলে রাখে। টানা হারলেও সমর্থকরা আবার মাঠমুখী হন। বোর্ডের শাস্তির জবাবেও সমর্থকরা পাশে থাকেন ভরসা হয়ে। অথচ সেই সমর্থকদের চারআনা পয়সার মূল্য দেন না সাকিবরা। তারা ধরেই নিয়েছেন, সমর্থকরা যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের পাশে থাকবেন কিন্তু বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করতে পারবেন না।

দল খারাপ করলে সংবাদ সম্মেলনে কোনো প্রশ্নেরই সোজা উত্তর দেন না সাকিব। উল্টো সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরী করেন। আর ভক্ত সমর্থকরা ঠিকই সেটা নিয়েই মেতে ওঠেন। সেই সমর্থকরাই কিন্তু এখন সাকিবকে ফেসবুকে ধুয়ে ফেলছেন, সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন সবখানে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের শেষ পরিণতি কিন্তু খুব একটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ১৭ বছর দেশের প্রতিনিধিত্ব করার পর সাকিবের এখন নিজেকেই তাই প্রশ্ন করা উচিত, দেশের জন্য কি করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.