তরুণরা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে কিন্তু কেন এমনটা হলো

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট ঘটনাকে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, জনগণ ভোটাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এটা এখন অধিকার আদায়ের আন্দোলন। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের দাবিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যে বলেন, তরুণদের সমর্থনে ২০০৮ সালে আওয়ামী সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু আজকে সেই তরুণরাই আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু কেন এমনটা হলো, তা ভেবে দেখা দরকার। তিনি বলেন, আজকে ছাত্রসমাজ ও তরুণরা যে দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে তার সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করছি এবং তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, কোটা আন্দোলন সহ অন্যান্য আন্দোলন হলো রোগের উপসর্গ মাত্র, রোগটা হলো ব্যাপক গুরুতর ও ভয়াবহ। আজকে ছাত্ররা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত।

ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক না হলে তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্ররা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, বাকস্বাধীনতা ও তাদের জীবনের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা ভোটাধিকার ও মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আর এই অধিকারগুলো অভিভাজ্য। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিগত তিনটি নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে জনগণের সম্মতিবিহীন একটি সরকার গঠন করেছে, যার কোনো লেজিটিমেসি নেই। এই সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের অন্যান্য রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে। আমরা খুনসহ সকল অন্যায়ের ন্যায়বিচার চাই। আমাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সকল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করার অবসান চাই। তা না হলে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার থাকবে না।

নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন বলেন, ক্ষমতাসীন দল অভিনব পদ্ধতিতে বিগত তিনটি নির্বাচন আয়োজন করেছেন তারা। এর মাধ্যমে দেশের সংবিধান ও নিজ দলের সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী দল। তাই এই দলের অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই দলের মধ্যে যে অসততা তৈরি হয়েছে তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসা ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিরাজমান সংকট নিরসনে সরকারের দিক থেকে কোনো আন্তরিক ও কার্যকর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে যে, তা ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। এবার যদি বিচার না পাই, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ থেকে বিচার শব্দটা একবারেই ওঠে যাবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের মাধ্যমে বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের চুপ হয়ে যাওয়ার বা সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, এই আন্দোলনে সরকারের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ৬১ জন মারা গিয়েছিল। তার চার গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে। এবারের গণঅভ্যুত্থানে নারী, শিশু, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ সব পেশার মানুষের সর্বজনীন উপস্থিতি ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট ঘটনাকে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জানিয়ে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, একসময় বলতাম এরশাদের হাতে শিক্ষার্থীদের রক্ত- ইতিহাস বলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যর্থ হয় না। এবারের আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। টগবগে তরুণদের প্রাণ গেছে। রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিজ দলের নেতাকর্মীদের ভুয়া ভুয়া স্লোগানের মুখে পড়তে হয়েছে। মতবিনিময় ডেকে কথা বলতে না দেয়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তার মানে আপনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংলাপেই তিনি অসৎ, ধূর্ততার পরিচয় দেন। কীভাবে বিরোধীদের সঙ্গে সংলাপ করবেন? ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সংলাপে কীভাবে সৎ হবেন?

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি এখনো ঘটেনি। প্রথম অবস্থায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিলে, আজকে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো বা হতো না।

দিলীপ কুমার সরকার বলেন, যে বিষয়গুলোর ওপর সরকারের গুরুত্ব আরোপ জরুরি তা হলো: নিহতদের নাম- পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত তালিকা প্রকাশ করা। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে মামলা না দেয়া, গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেয়া এবং গায়েবি মামলা ও ব্লকরেইড দিয়ে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার বন্ধ করা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নিরাপত্তা দেয়া এবং ভবিষ্যতে হয়রানি না করার অঙ্গীকার করা। শিক্ষার ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে বাকস্বাধীনতাসহ জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং স্বাধীন ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার বন্ধ করা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকা।

No comments

Powered by Blogger.