৩২ ঘণ্টা অনশন, মুক্ত ৬ সমন্বয়ক
নিরাপত্তা হেফাজতের কথা বলে গত শুক্রবার বিকালে তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকেরকে ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে আনা হয়। নাহিদ ও আসিফ অসুস্থতাজনিত কারণে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বাকেরও সেখানে উপস্থিত থাকায় তাকেও তুলে আনা হয়। পরদিন শনিবার সন্ধ্যায় সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। এরপর রোববার ভোরে মিরপুরের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তুলে আনা হয় নুসরাত তাবাসসুমকে। এরপর থেকে তারা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ছিলেন। ডিবি প্রথম থেকে বলে আসছিল, সমন্বয়করা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা হেফাজতের কথা বলে ৬ সমন্বয়ককে ডিবিতে রাখা নিয়ে দেশ জুড়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয় ডিবি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। সোমবার সমন্বয়কদের অবিলম্বে মুক্তি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দাখিল করেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। সোমবার ও মঙ্গলবার রিটের ওপর হাইকোর্টের এই দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি হয়। আদালতের গতকালের কার্যতালিকায় রিটটি আদেশের জন্য ১০ নম্বর ক্রমিকে ছিল। তবে অসুস্থতার কারণে বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন বুধবার ও গতকাল বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়েছেন। এজন্য এই ২দিন শুনানি হয়নি। এর আগে গত ১৯শে জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় এক বন্ধুর বাসা থেকে নাহিদকে তুলে আনা হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পর পূর্বাচল এলাকায় তাকে পাওয়া যায়। ওই সময় নাহিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হন। অপর দুই সমন্বয়ক আসিফ ও বাকেরকেও একই দিন তুলে নেয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন পর তাদের দুজনকে চোখবাঁধা অবস্থায় যেখান থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল সেখানে ফেলে যাওয়া হয়। এরপর থেকে আসিফও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন বাকেরও।
নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেককে ডিবির আলাদা আলাদা গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ৩২ ঘণ্টা অনশনের কারণে তারা সবাই ক্লান্ত। এদিকে, গতকাল সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ মানবজমিনকে বলেছেন, আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশন করে আমরা সফল হয়েছি। আমাদের তারা হাইকোর্ট দেখানো শুরু করেছে। তারা বলছেন, বিষয়টি হাইকোর্টে চলে গেছে। আমাদের কিছু করার নেই। বিষয়টি আমরা মেনে না নিয়ে বুধবার রাত থেকে অনশন শুরু করি। প্রথম অনশন শুরু করে আসিফ মাহমুদ। আমাদের ৬ জনকে আলাদা আলাদা সেলে রাখা হয়। যাতে করে পরস্পরের মধ্যে কোনো আলোচনা না করতে পারি। ডিবি কার্যালয়ের পুকুরের দিকে দেখা হলে হঠাৎ জানতে পারি সমন্বয়ক আসিফ অনশনে আছেন। পরে আমরা সবাই একসঙ্গে শুরু করলাম। অনশনের কারণে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারের মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ কমে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে বাকেরকে পানি খাওয়ানো হয়। কিন্তু বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা বাকিরা অনশন ভাঙিনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, হয় আমাদের গ্রেপ্তার দেখাবে অথবা ছেড়ে দিবে। ২৪ ঘণ্টার বেশি হেফাজতে রাখার সিস্টেম তো কোথাও নেই। ইতিমধ্যে ৬ দিন হয়ে গেছে। হাইকোর্টের শুনানি একেকটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পেছাচ্ছিল। আমাদের প্রত্যেকের একজন করে নিজস্ব অভিভাবক আসলে জিম্মানামায় সই করে দুপুরে ৬ জনকে আলাদা আলাদাভাবে ছাড়া হয়। হাসনাত বলেন, এখন যেহেতু মানসিকভাবে আমরা বিপর্যস্ত। ৬ দিন ধরে একধরনের গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এই পুরো সময়টাতে বাইরে কী হয়েছে, আন্দোলন কোন পর্যায়ে আছে আমরা কিছুই জানি না। শুনেছি গণগ্রেপ্তার চলছে। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে আমরা একটি সমন্বিত বক্তব্য জানাবো। ইতিমধ্যে দেখেছি অখণ্ড বক্তব্যের কারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমাদের ওপর বিভাজন পলিসি আরোপের চেষ্টা করেছে। পরিস্থিতিটা আমরা একটু পর্যবেক্ষণ করে নিজেরা একটু সুস্থ হই, ডাক্তার দেখাই তারপর সমন্বিত সিদ্ধান্ত জানাবো। এই মুহূর্তে আমরা একটি নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আন্দোলন-কেন্দ্রিক সমপ্রতি গোয়েন্দা কার্যালয়ে থাকাকালীন আমরা যে একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছি এই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আছে। তবে সেটা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানাবো। এদিকে হাসনাত তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেন, এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার গণঘৃণার নামান্তর। আমাদের মুক্তি তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটিও মুক্তি পাবেন। এই গণগ্রেপ্তার কেবল নিরপরাধ মানুষের অধিকার হরণ নয় বরং আমাদের সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়া একটি নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন। এটি মুক্তচিন্তা ও মানবাধিকারের প্রতি এক ভয়ানক আঘাত। আমাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ব্যক্তির মুক্তির জন্য নয় বরং বৈষম্য, নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার এবং ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
ওদিকে নিরাপত্তা হেফাজত থেকে মুক্ত সারজিস আলম তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কথা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না, মামলা দিয়ে হয়রানি করবেন না। আপনারা কথা রাখেননি। আপনারা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর আঘাত করেছেন। সারা দেশে আমার স্কুল কলেজের ভাইবোনদের ওপর লাঠিচার্জ করেছেন। যাকে ইচ্ছা তাকে জেলে পাঠিয়েছেন। আন্দোলনকারীকে খুঁজে না পেলে বাসা থেকে ভাইকে তুলে নিয়েছেন, বাবাকে হুমকি দিয়েছেন। মাশরুর তার উদাহরণ। যারা একটিবারের জন্যও এই আন্দোলনে এসেছে তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারে না, গ্রেপ্তারের ভয়ে থাকে। এমন অনেকে আছে যাদের পরিবার এখনো তাদের খোঁজ পায়নি। এমন তো হওয়া উচিত ছিল না। কোথায় মহাখালীর সেতু ভবন আর কোথায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আপনারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মহাখালীর সেতু ভবনে হামলার জন্য গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলেন। সঙ্গে আছেন আসিফ মাহতাব স্যার, মাশরুরসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য শিক্ষার্থী। রিকশা থেকে নামিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলছেন, বাসা থেকে তুলে নিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। আমার বোনদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছেন। কী ভাবছেন? এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? তিনি আরও লিখেছেন, ৬ দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ৬ জনকে আটকে রাখা যায় কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত সেগুলো কীভাবে নিবৃত করবেন? পুলিশ ভাইদের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলি। এ দেশের মানুষের ক্ষোভ আপনাদের ওপর নয়, পুলিশের ওপর নয়। এই ক্ষোভ আপনার গায়ের ওই পোশাকটার ওপর। যে পোশাকটাকে ইউজ করে বছরের পর বছর আপনাদের দিয়ে এ দেশের অসংখ্য মানুষকে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, জেল আর আদালতের প্রাঙ্গণে চক্কর কাটানো হয়েছে, সেই পোশাকটার ওপর। ওই পোশাকটা ছেড়ে আসুন আমাদের সঙ্গে, বুকে টেনে নিবো। এ পথ যেহেতু সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ, তাই যেকোনো কিছু মোকাবিলা করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। যতদিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে, গণগ্রেপ্তার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে ততদিন এ লড়াই চলবে।
No comments