আফগান শান্তিপ্রক্রিয়া by আসাদ হোসাইন

সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৭৯ সালের আফগান অভিযানের আগে এশিয়া মহাদেশের বাইরে আফগানিস্তান ছিল স্বল্প পরিচিত একটি দেশ। ঐতিহাসিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদেরা এই স্থানকে স্রেফ এশিয়ার একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র বিবেচনা করতেন। একটি প্রাচীন অঞ্চল হিসেবে এর ভৌগোলিক গুরুত্বের কথাও তারা স্মরণ করিয়ে দিতেন। ভৌগোলিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বিবেচিত হওয়ার আগে এই স্থানটি ব্যাকট্রিয়া নামে পরিচিত ছিল।
আলেক্সান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ সালে ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল আক্রমণ করেন, তবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাননি। ব্রিটিশরা ১৮৩৯-৪২ ও ১৯৭৮-৮০ সময়কালে অভিযান চালিয়ে পরাজিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাগ্য পরীক্ষা করে স্নায়ুযুদ্ধকালে, ১৯৭৯-৯১ সময়কালে। এই অঞ্চলকে বশীভূত করার চেষ্টা করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, কিন্তু আফগানিস্তান অজেয় হয়ে থাকে। আমেরিকা তার যুদ্ধপ্রিয় ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ৯/১১-এর ব্যানারে আফগানিস্তানে রক্তাক্ত অভিযান চালায়। এর জের ধরে ১৮ বছর ধরে রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য চলছে।
পরাশক্তিগুলো এখানকার অকুতোভয় যোদ্ধাদের কাছ থেকে এই এলাকাটি দখল করতে পারেনি। ফলে অন্য শক্তিগুলোর মতো যুক্তরাষ্ট্রকেও আলোচনার টেবিলে এসে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রয়াস চালাতে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান নামে পরিচিত আফগান ধাঁধা অবসান করার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হয়েছে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন আফগান গ্রুপের সাথে সপ্তম দফার আলোচনা চালাচ্ছে। আফগানিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পদ ও সামরিক হতাহত থেকে রক্ষা পেতে এখান থেকে সরে যাওয়ার একটি পথ খুঁজছে। ওভাল অফিসে প্রবেশের পর পরই ট্রাম্প তার আমলাদের নির্দেশ দেন এমন একটি পথ বের করতে, যাতে আফগানিস্তানে আমেরিকান স্বার্থ সর্বোত্তমভাবে রক্ষিত হয়। তিনি যত দ্রুত সম্ভব আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেন।
নিকট অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা শুরু নিয়ে কথাবার্তা চলার সময় মার্কিন ড্রোন হামলায় তালেবানের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিহত হয়। এতে আলোচনার উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৫ সালে মারি আলোচনা ব্যর্থ হয় মোল্লা উমরের মৃত্যুতে। মোল্লা আখতার মানসুরের রহস্যজনক মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, চীন ও পাকিস্তানকে নিয়ে গঠিত চার দেশীয় উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে যায়। মস্কো শান্তি আলোচনা ও হার্ট অব এশিয়া আলোচনাও ব্যর্থ হয়।
তবে বর্তমানে কাতারে আফগান তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে আলোচনা চলছে, তাতে মার্কিনিদের সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। তাদেরকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে।
কাতারে চলমান যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যকার আলোচনায় তিনটি প্রধান এজেন্ডা রয়েছে:
  • আফগানিস্তান থেকে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর প্রত্যাহার
  • আফগানিস্তানে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি; বিদ্রোহীদের আফগান ও আমেরিকা বাহিনীর ওপর আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি
  • আন্তঃআফগান আলোচনা এবং তাতে আফগান সরকারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা।
তবে তালেবান পক্ষ আফগান সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয়। তারা কাবুল সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার মনে করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায়, আফগান সরকারকে শান্তি আলোচনার অংশ করা হোক। তবে শান্তি আলোচনায় সব পক্ষই সমঝোতার আভাস দিয়ে যাচ্ছে।
তবে নানা জটিল কারণে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজ কাজ হবে না। বিশেষ করে ব্যাপক দুর্নীতি, সাবেক যোদ্ধাদের একীভূত করা, নারীদের অধিকার, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা, অবৈধ মাদক ব্যবসা, নাজুক পুলিশব্যবস্থার কারণে সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে শান্তি ও উন্নয়ন কামনা করে, তবে তাকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই আফগানিস্তানের বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ করতে হবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে, তালেনবানকে যথাযথ হিস্যা দিয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের কিছু করতে পারলেই সহিংসতাজর্জরিত দেশটিতে শান্তি ফিরতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.