৪ হাসপাতাল বদলের পর শাকিলের মৃত্যু by শুভ্র দেব

‘আমার শাকিলকে আর বাঁচাতে পারলাম না। পোলাডা কিছু না খেয়েই মইরা গেল। তোমরা আমার পোলাডারে আইন্না দাও। আমারে মা বলে ডাকবে কে? দেশে কি ডেঙ্গুর কোন চিকিৎসা নাই? কোন ডাক্তার নাই? বিনা চিকিৎসায় ছেলেটা মারা গেল।’ গতকাল ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া শাকিলের মা নার্গিস বেগম এভাবেই বিলাপ করছিলেন। আত্মীয়-স্বজন কেউই তাকে শান্তনা দিতে পারছিলেন না। মায়ের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি হাসপাতাল। সন্তান হারানো এই মায়ের আর্তনাদ দেখে উপস্থিত কেউই  চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি।

নয় বছর বয়সী শাকিল।
মিরপুরের একটি স্কুলের শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে মিরপুর-১ নম্বরের বাসায় থাকতো। ২ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট শাকিল। বাবা কামাল গাড়ি চালক ও মা নার্গিস আক্তার গৃহিনি। তাদের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগি উপজেলায়। সাত দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল শাকিল। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তার ডেঙ্গু হয়েছে। ধীরে ধীরে তার রক্তের প্লাটিলেট কমতে থাকে। এরপর তার বাবা-মা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নিয়ে ঘুরতে থাকেন। কোথাও ঠিকমত চিকিৎসা মেলেনি। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই চিকিৎসার সময় পার হয়েছে। অবশেষে সোমবার রাত পৌনে চারটার দিকে শাকিল ডেঙ্গুর কাছে পরাস্থ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।

শাকিলের বাবা কামাল বলেন, ৩০শে জুলাই হঠাৎ করে জ্বর আসে শাকিলের। জ্বরের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে তাকে ভর্তি করা হয় শাহআলী মাজার রোডের সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে। ডেঙ্গুর পরীক্ষা করলে পজিটিভ আসে। প্লাটিলেট কমতে থাকে। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। সেলিনা হাসপাতালে চারদিন রাখার পর অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বরং তার লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। পরে তারা সেখান থেকে ছেড়ে দিয়ে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে বলে। আমরা তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। সেখানে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একদিনের মত রেখে সেখান থেকেও তাকে ছাড়পত্র দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। শাকিলের মা নার্গিস বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলে যখন তাকে নিয়ে আসি তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যন্ত্রণায় সে না পারছিলো বসতে না পারছিলো ঘুমাতে। প্রতিনিয়ত ছটফট করছিলো। ভেবেছিলাম এই হাসপাতালে ভর্তি করলে ভাল চিকিৎসা পাবে কিন্তু সেটা হয়নি। ওই দিন বিকালে জরুরি বিভাগ থেকে শাকিলকে পাঠানো হয় দ্বিতীয় তলার শিশু ওয়ার্ডে। সেখানে যাওয়ার পর আমাদের বলা হয় এত বড় শিশু ভর্তি করা যাবে না। পরে বলা হয় শাকিলের অবস্থা খারাপ তাই তার আইসিইউ লাগবে। কিন্তু আইসিইউতে কোন সিট খালি নাই। অন্য ওয়ার্ডে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। আর চিকিৎসা করাতে হলে পরিবারের সবাইকে সম্মতিপত্র দেয়া লাগবে। রোগীর কিছু হলে সকল দায়-দায়িত্ব পরিবারকে নিতে হবে। মৃত্যর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলো ছেলেটা। এসব হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসার চেয়ে নিয়ম কানুন মানতে মানতে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায়। আমরা গরীব অসহায়, লেখাপড়া না জানা মানুষ। আমাদের সঙ্গে কেউ ভালভাবে কথাও বলে না। কি বলে সেটাও বুঝি না। চিকিৎসা না পেয়ে ছেলের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। যন্ত্রনায় চিৎকার করছিলো। কেউ তাকে আটকাতে পারছিলাম না। পরে বাধ্য হয়ে সেখান থেকে তাকে মোহাম্মদপুরের কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি।

শাকিলের বাবা মো: কামাল অভিযোগ করে বলেন, সোমবার রাত ১১টার দিকে কেয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসক আমাকে ডেকে বলেন আপনার ছেলে খুব অসুস্থ সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। পরে আমি শাকিলের কাছে যাই। সে আমাকে দেখেই বলে আব্বা আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার হাত-পা বেধে রেখেছে। আর শুধু ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। আমি তখনই বলছিলাম একটু পর পর ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার ছেলেটারে মেরে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। রাত সাড়ে তিনটায় একটি ইঞ্জেকশন দেয়ার পরপরই শাকিল নিস্তেজ হয়ে যায়। পরে আর তার জ্ঞান ফিরে নাই। অভিযোগ করে কামাল আরও বলেন, সেলিনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে শুরু করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল ও কেয়ার হাসপাতাল চারটি হাসপাতাল বদল করে শাকিলরে কোন চিকিৎসা দিতে পারি নাই। কোন লাভ হয় নাই এসব হাসপাতালে নিয়ে। বরং আমাদের অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। সেলিনা হাসপাতালে চারদিনে আমাদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিছে। কিন্তু কোন চিকিৎসাই মিলেনি।

No comments

Powered by Blogger.