সংশোধনীতে পঙ্গু ভারতের তথ্যাধিকার আইন by পি কে বালাচন্দ্রন

তথ্যাধিকার আইন সংশোধনের প্রতিবাদে
ভারতের পার্লামেন্টে সে দেশের তথ্যাধিকার আইন, ২০০৫-এর একটি সংশোধনী পাস হয়েছে গত সপ্তাহে। এর ফলে আইনটি কার্যত পঙ্গু হয়ে পড়েছে।

এটা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় পর্যায়েই তথ্য কমিশনারদের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। এছাড়া এটি কেন্দ্রের কাছে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করায় রাজ্যগুলোর অধিকার খর্ব হয়েছে।

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর মিত্রদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সংশোধনীটি পাস হয়। তবে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, দ্রাভিদা মুনেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) এর তীব্র বিরোধিতা করে।

সংশোধনীতে তথ্য কমিশনারদের ৫ বছরের মেয়াদ, তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিদ্যমান বাধ্যবাধকতা, আরটিআই অ্যাক্ট বাস্তবায়নে রাজ্যগুলোর ভোগ করা স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এখন থেকে প্রতিটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। ফলে ভারতীয় সংবিধানের কেন্দ্রীয় কাঠামো আরো দুর্বল হয়ে পড়ল।

২০০৫ সালের মূল আরটিআই আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনার (সিআইসি), কেন্দ্রের তথ্য কমিশনার (আইসি), রাজ্যের তথ্য কমিশনাররা নির্দিষ্ট ৫ বছর মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হতেন। সিআইসি ও আইসিরা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের সমান বেতন পেতেন। রাজ্যের তথ্য কমিশনারদের বেতন ধরা হয়েছিল রাজ্যের মুখ্য সচিবের সমান।

নতুন সংশোধনীর ফলে তথ্য কমিশনারদের চাকরির মেয়াদ নির্ধারিত হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার ওপর। রাজ্যগুলোর কোনো বক্তব্য থাকবে না।

সংশোধনীটির তীব্র বিরোধিতা করে বিরোধী দলের এমপিরা বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এখন মেয়াদ বা বেতন পরিবর্তনের হুমকি দিয়ে তথ্য কমিশনারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। কিংবা তাকে বেতন ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রলোভন দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারে।

অভিযোগ রয়েছে, মোদি সরকারের এই সংশোধনী করতে চাওয়ার কারণ হলো, ২০০৫ সালের আরটিআই আইনের বলে লোকজন অস্বস্তিকর প্রশ্ন করছিল। আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টের আবেদনের প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তথ্য কমিশনার শ্রীধর আচারিলু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন ১৯৭৮ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের রেকর্ড দেখতে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ওই বছর ওই পরীক্ষায় পাস করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। মোদি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্যিই পাস করেছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টির মধ্যে এটি জানতে চাওয়া হয়েছিল।

এর কয়েক দিনের মধ্যেই তথ্য কমিশনার পদে থাকাকালেই তার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পদবি বাতিল করা হয়।

আরেক ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে (আরবিআই) আরটিআই আবেদনের ভিত্তিতে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর নন-পারফরমিং এসেট (এনপিএ) এবং বিশেষ করে বড় বড় ঋণ খেলাপির তথ্য জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আরবিআই তা প্রদান করতে অস্বীকার করলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে উত্থাপন করা হয়। সেখানে তথ্যটি প্রকাশ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর অফিসের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং ২০১৯ সালের সংশোধনীর পক্ষে পার্লামেন্টে বলেন, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনারকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার রায় হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। এটা কেমন করে হয়।

তবে বিরোধীরা উল্লেখ করেন, বিষয়টি তা নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের রুলিং, এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আদেশও সুপ্রিম কোর্টে নেয়া যেতে পারে। এই সংশোধনের ফলে তথ্য কমিশনারদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ করার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

বিরোধী দলের সদস্যরা উল্লেখ করেন, মোদি সরকার কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনে শূন্য থাকা চারটি তথ্য কমিশনারের পদ পূরণ করতে আগ্রহী নয়। এখন পর্যন্ত ১০টি পদের বিপরীতে মাত্র ছয়জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে, সিআইসিকে দুর্বল করতেই পদগুলো পূরণ করা হচ্ছে না।

মজার ব্যাপার হলো, সূচনায় সিআইসি ও আইসিদের পদমর্যাদা ও বেতন নির্ধারণ করেছিল যে পার্লামেন্টারি কমিটি, তাতে তখনকার বিজেপি এমপি রাম নাথ কবিন্দ (বর্তমানে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি), রাম জেঠমালিনি (তিনি এখন আর বিজেপিতে নেই) ও বালাবন্দ আপ্তেও ছিলেন।

কংগ্রেস এমপি শশী থারুর বলেন, সংশোধনীগুলো করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য তথ্য কমিশনারদের কর্তৃত্ব খর্ব করতে ও প্রতিষ্ঠানকে দন্তহীন বাঘে পরিণত করতে।

এই সংশোধনী সরকারকে স্বাধীন তথ্য কমিশনার নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা দেবে।

কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের সাবেক সাত কমিশনার এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ, দীপক সাধু, শৈলেশ গান্ধী, অধ্যাপক শ্রীধর আচায়ুলু, এম এম আনসারি, যশোবর্ধন আজাদ ও অন্নপূর্ণা দিক্ষিত।

ত্রুটির সমাধান

অবশ্য উল্লেখ করতেই হবে যে তথ্যাধিকার আইন ২০০৫-এর বাস্তবায়ন তেমন সন্তোষজনক ছিল না। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমলাতন্ত্রের মধ্যে রেকর্ড রাখার দুর্বল ব্যবস্থা, অবকাঠামো ও কর্মীর অভাব, পরিপূরক আইনের অভাবের ফলে এটি কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না।

সাক্ষীর সুরক্ষা

এরপর আসে সাক্ষীর সুরক্ষা। এখন পর্যন্ত ৬৫ জন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট বা তথ্য প্রকাশকারী সংশ্লিষ্ট দলগুলোর হাতে নিহত হয়েছেন।

তাছাড়া আরটিআই আইনে অনেক ‘স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে’ তথ্য প্রদান করতে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এগুলো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাধীন।

আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্টও পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই আইন সরকারকে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এখন সরকার সন্ত্রাসী হিসেবে ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও আইনটি প্রয়োগ করতে চাইছে। এখন পর্যন্ত যথার্থ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর সন্ত্রাসী আইনের কেউ সন্ত্রাসী ঘোষিত হলেই তার ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু সরকারই যে কাউকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করার ক্ষমতা চাইছে। এতে করে ফ্যাসিবাদী সরকার আরটিআই অ্যাক্টিভিষ্ট বা সোচ্চার লোকদের প্রতিহিংসাপরায়ণ বা সন্ত্রাসী ঘোষণা করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.