রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রুজ্ঞান কেন by এমাজউদ্দীন আহমদ

দেশে নানারকম অনিয়ম, দুর্নীতি যে হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদে এর প্রতিফলন ঘটছে। ব্যাংক ঋণে কেলেঙ্কারি, সরকারি নানা প্রকল্পে অনিয়ম ইত্যাদি তো থেমে নেই। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার কারাবন্দি নিয়ে নানা মহলে সঙ্গতই উচ্চকণ্ঠে আলোচনা হচ্ছে। তবে এ কথা আমি মনে করি যে, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি পর্যালোচনা করলে বিএনপি চেয়ারপারসনের জয় হয়েছে। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রুজ্ঞান করে এমন নির্মমতা দেখানো হয় না। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি রাষ্ট্র ও রাজনীতির চিত্র বিবর্ণ করে, নানামুখী সংকট সৃষ্টি করে। এই সংকট আমাদের জন্যও অমঙ্গল ডেকে আনে। এর ফলে প্রতিপক্ষের ক্ষতির পাশাপাশি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষতি হয় অপরিসীম এমন চিন্তা কিংবা কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র-সমাজ অথবা রাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের জন্য বহুমুখী নেতিবাচকতার কারণ হয়েও দাঁড়ায়। সরকারের নীতিনির্ধারকরা গণতন্ত্রের উৎকর্ষ, বিকাশ কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অনেক রকম ইতিবাচক কথা বলছেন বটে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান বাস্তবতা কি এর বিপরীত নয়? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রুজ্ঞান করা হবে কেন? যেখানে এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান, সেখানে কোন ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। এমনটি সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ ক্রমেই জটিল করে তুলছে। আইনের শাসন, ন্যায়বিচারের আকুতি সত্ত্বেও আমরা এসবের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শ করতে পারছি না। প্রতিহিংসার রাজনীতি তো কখনও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাপ্রসূত সুস্থ রাজনীতির অংশ হতে পারে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক কূটকৌশল কিংবা প্রতিহিংসার রূপও ততই প্রকট হচ্ছে। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেমন করা সম্ভব নয়, তেমনি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়টিও থেকে যাবে অনিশ্চিত। এসব ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা প্রীতিকর নয়। দলবিহীন, ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং গত জাতীয় নির্বাচনোত্তর যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা আমাদের জন্য মোটেও গৌরবের বিষয় নয়। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবিতে দলের তরফে যেসব কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে সবই ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে পুলিশের মারমুখী অবস্থানের কারণে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি গণতান্ত্রিক পন্থায় তাদের নেত্রীর কারামুক্তির দাবিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি পালন করতে পারবে না অথচ সরকারের তরফে অহরহ শোনানো হবে গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বাণী, এমনটি কি স্পষ্টতই স্ববিরোধিতা নয়? বিএনপির শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অহরহ যে অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ তা কি গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য? পুলিশ যে মারমুখী কায়দায় বাধা দিয়ে তাদের সব কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দিচ্ছে তা তো কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র হতে পারে না। এমতাবস্থায় সঙ্গতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে মিল কোথায়? এমন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারের বেপরোয়া মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীলরা হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে কিংবা নিজেদের কষা ছকে এমন বৈরী আচরণ করছেন না। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের নির্দেশই পালন করছেন- এটি খুব সহজ-সরল বিশ্নেষণে প্রতীয়মান হয়। যদি সরকারের নির্দেশ এসব ক্ষেত্রে এমন না থাকে তাহলে সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন? যদি সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত তাহলে প্রতীয়মান হতো, সরকারের কথা ও কাজে মিল রয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশকে কেন্দ্র করে দলটির নেতারা কোনোরকম হিংসাশ্রয়ী কর্মসূচি দেননি বা দিচ্ছেন না। তারা শান্তিপূর্ণ পন্থায় তাদের নেত্রীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন; কিন্তু তাদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছে না। তারা হরতাল-অবরোধের পথে হাঁটেননি। পরিস্থিতি অরাজক হয়ে উঠুক এমনটি তারা যে কোনোভাবেই চান না এটি তো তাদের প্রদত্ত কর্মসূচির মধ্য দিয়েই স্পষ্ট। বিএনপি জনসমর্থিত বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে অত্যন্ত সাদামাটা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময় ও উদ্বেগের বিষয় হলো, এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও দলটির নেতাকর্মীরা পালন করতে পারছেন না। এই কর্মসূচিগুলো পালন করতে গিয়ে তারা যে কেবল হামলা ও বাধার মুখেই পড়ছেন তাই নয়, নেতাকর্মীদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, রীতিনীতির অনুশীলন ছাড়া কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সমাজের কথা অকল্পনীয় এই সত্য অস্বীকারের অবকাশ নেই। সরকারের অনেকেও এমন উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এ রকম উচ্চারণ আর বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য খতিয়ে দেখতে গভীর দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে কি? বহু ক্ষেত্রেই স্পষ্টভাবে দেখা যায় স্ববিরোধিতা। গণতন্ত্রের অপরিহার্য কিছু শর্ত আছে। পরমতসহিষুষ্ণতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, রুচি, সমঅধিকার ইত্যাদি এর মধ্যে অন্যতম। গণতান্ত্রিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইত্যাদির অভাব দেখা দিলে বহুমুখী সংকট দেখা দেয়। আমাদের দেশের রাজনীতি এই সংকটমুক্ত হতে পারছে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা-আন্তরিকতা-পরিচ্ছন্নতা যদি থাকে তাহলে বৈরিতা এড়িয়ে সৃজনশীল, জনকল্যাণমুখী রাজনীতির পথ প্রশস্ত করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। ক্ষমতাসীনদের তরফে জনকল্যাণ কিংবা সুস্থ রাজনীতি চর্চার অঙ্গীকার ব্যক্ত হলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রতিফলন কতটা লক্ষ্য করা যায়? বিগত কয়েক দশকে বিশ্বে গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরাও এর বাইরে নই। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তনের যে কথা উচ্চারিত হয় এর কোনো কিছুই উল্লিখিত বিষয়গুলো ব্যতিরেকে নয়। মূল কথা হলো, সুন্দর মনোভাব নিয়ে ইতিবাচক রাজনীতির বিকাশে কাজ না করলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। সহমর্মিতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকেই দেশে রাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কিংবা হচ্ছে। এ দেশের মানুষ বরাবরই চেয়েছে সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজ। নামকাওয়াস্তে সংসদীয় গণতন্ত্র এ দেশের মানুষ চায়নি। সুস্থ রাজনীতির বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, তেমনি বর্জন করতে হবে প্রতিহিংসার রাজনীতি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল ও ভিন্ন মতের জন্য অধিকারের সমতল ভূমি করাটা সর্বাংশে জরুরি। বিএনপির নেতাকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কালো পতাকা প্রদর্শনের কিংবা মানববন্ধনের মধ্যে অহিংস কর্মসূচিও পালন করতে যদি না পারেন তাহলে কী করে বলব যে, আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি? সরকারের কয়েকজন দায়িত্বশীল বিগত কয়েক সপ্তাহে নতুন প্রেক্ষাপটে ইতিমধ্যে বহুবার বলেছেন যে, 'সরকার কারও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে না। সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দিচ্ছে না।' তাদের অনেকেই এ কথাও বলেছেন যে, 'সুষ্ঠু রাজনৈতিক আন্দোলন করলে বরং বিএনপিকে সহযোগিতা করা হবে।' এমন আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির পরও কি প্রতিহিংসার চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে না? অসংযত ও অসহনশীল বক্তৃতা-বিবৃতি না দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে সরকারকে সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বৃহৎ প্রয়োজনের নিরিখে। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কিংবা অজুহাত দাঁড় করানো নয় বরং কথা ও কাজে মিল রাখার ক্ষেত্রে পরিচয় দিতে হবে আন্তরিকতা-সদিচ্ছার। বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে সেসব কর্মসূচি পালনে জনজীবনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা মোটেও নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্বশীলদের উচিত, নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা বজায় রেখে অধিকার পালনের পথে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সবসময় অনুমতি কিংবা প্রশাসনের অনুমোদনই-বা নিতে হবে কেন? সদাসর্বদা অনুমতির বিষয়টি তো গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়টিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। অবশ্যই প্রত্যাশিত যে, সরকারের দায়িত্বশীলরা বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মতো জরুরি বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেবেন। অনুমতি রাজনীতি গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক অধিকারের সমতল ভূমি নিশ্চিত করা। হিংসা-প্রতিহিংসা বর্জন করে পরমতসহিষ্ণু হয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে রাজনীতির পথ মসৃণ করতে হবে। জনগণের জন্যই রাজনীতি। রাষ্ট্রের কল্যাণগত এর মধ্য দিয়েই নিশ্চিত করা হয়। নিশ্চয়ই দায়িত্বশীলরা এমন সত্য স্বীকার করবেন না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে সবার অংশগ্রহণমূলক হয়, এমন পরামর্শ যখন বিভিন্ন মহল থেকে দেওয়া হচ্ছে, তখন সরকারের দিক থেকে কী প্রতিফলিত হচ্ছে? এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডের নিরসন ভিন্ন সুস্থ রাজনীতির পথ মসৃণ করা দুরূহ। রাজনীতি ও নির্বাচনের জন্য সমতল ভূমি নিশ্চিত করা না গেলে এর ফল ইতিবাচক হবে কীভাবে?
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

No comments

Powered by Blogger.