ঢাকা উত্তরের সংস্কার প্রকল্পের উল্টোযাত্রা by সুদীপ অধিকারী

রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক ও বসবাসের উপযোগী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। এসব পদক্ষেপে বদলে যাওয়া শুরু করেছিল বিভিন্ন এলাকার দৃশ্যপট। কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুর পর সেসব প্রকল্প কতটুকু এগিয়েছে? আনিসুল হকের প্রথম ও প্রধান পরিকল্পনা ছিল সবুজ  ঢাকা গড়া। রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজ, রাস্তার আশপাশসহ প্রতিটি বাসা-বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি ডিএনসিসির বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে ফুটওভার ব্রিজে লাগানো গাছ অনেকটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও তা ঢাকা পড়েছে রাজনৈতিক ব্যানারে। এবিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, গাছ লাগানোর বিষয়টি মূলত মৌসুমভেদে করা হয়। সধারণত বর্ষার সময়ে সবচেয়ে বেশি গাছ লাগানো হয়। শুস্ক মৌসুম হওয়ায় এখন এই গাছ লাগানো প্রকল্পটিতে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে। ঢাকা উত্তরের আওতায় থাকা বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করতেও অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন আনিসুল হক। কারোর সঙ্গেই আপস না করে উচ্ছেদ অভিযানে নিজে হ্যান্ডমাইক নিয়ে ছুটে যেতেন তিনি। লড়াই করেই তিনি উদ্ধার করেন কাওরান বাজার ট্রাক স্ট্যান্ডের দখল হওয়া সরকারি জায়গা। তারই তত্ত্বাবধানে গত বছরের জুলাই মাসে উদ্ধার করা হয় গাবতলীর বেড়িবাঁধে অবস্থিত গাবতলী-সরদরঘাট সড়কের দুই পাশের দখল হওয়া ৩৭ একর জমি। ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ারের নেতৃত্ব্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দুদিনের উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় ৫ শতাধিক অস্থায়ী টিনশেডের স্থাপনা, ৫০টি স্থায়ী দোকানঘর, ইট-বালুর আড়ত, সীমানা প্রাচীরসহ অসংখ্য টায়ারপট্টি উচ্ছেদ করা হয়। তখন ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, উদ্ধারকৃত স্থানে কেন্দ্রীয় পরিবহন ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সম্প্রতি সরজমিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গাবতলীর উদ্ধারকৃত সেই জায়গার একটুও খালি নেই। আবারও সেই ইট-বালু আর পাথরের পশরা সাজিয়ে নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। টিন সিডের ইট-বালুর দোকানের সঙ্গেই চলছে বাস-ট্রাক মেরামতের গ্যারেজও। উচ্ছেদের ভয় না থাকায় অনেকেই আবার টিন ও স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন স্থায়ী দোকান ঘর। অন্যদিকে কাওরান বাজারের দখলমুক্ত করা জায়গায় আবার গড়ে উঠেছে  ট্রাকস্ট্যান্ড। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই সেখানে এসে ট্রাক থামিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন চালকরা। দখল হয়ে গেছে ডিএনসিসির অন্তর্গত ফার্মগেট, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মহাখালী, মগবাজার, আগারগাওসহ বিভিন্ন রাস্তার পাশের ফুটপাত। অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এসব এলাকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করলেও এখন সেসব স্থানে আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুর, আগারগাঁও কোনো রাস্তার পাশের ফুটপাতই এখন খালি নেই। এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তার পরও হকাররা সেখানে দোকান নিয়ে বসেন। আর এজন্যই আমরা কিছু সপ্তাহ বা মাস পরপর এই অভিযান চালনার উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া রাজধানীর বহুল প্রতীক্ষিত গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ঢাকায় চার হাজার বাস নামানোরও ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রয়াত মেয়র। কিন্তু সে পরিকল্পনা এখনও ঘোষণার মধ্যেই আটকে আছে। নতুন বাস নামানোর বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুর রাহমান বলেন, নতুন বাস নামানোর কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষকে (ডিটিসিএ)। তবে ডিটিসিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকল্পটির বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতির বিষয়ে জানা যায়নি। এছাড়া আনিসুল হক মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালে রাজধানীর ফুটপাতকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা রোধে, সড়কের দুপাশেই স্থাপন করেছিলেন ডাস্টবিন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, এখন রাস্তার পাশের ফুটপাতে হাতেগোনা দু-একটি ডাস্টবিন থাকলেও বেশির ভাগই চুরি হয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোরও বেহালদশা। ফুটপাতের পাশের এসব ডাস্টবিনের বর্তমান অবস্থা এবং আবারও নতুন কোনো ডাস্টবিন স্থাপন করা হবে কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম এ রাজ্জাক বলেন, যে কারণেই হোক আমাদের প্রথম উদ্যোগটা ভেস্তে গেছে। কিন্তু আবারও ফুটপাতে ডাস্টবিন স্থাপন করবো আমরা। এজন্যই বেশি টেকসই ডিজাইন চেয়ে আমরা অচিরেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষের আচরণ, আবহাওয়া, সৌন্দর্য বিভিন্ন দিক বিবেচনায় ডাস্টবিনের যে ডিজাইনটি ব্যবহার বান্ধব বলে মনে হবে, সেটাকেই আমরা নির্বাচন করবো। তবে সব প্রক্রিয়া শেষ করে কবে নাগাদ ডাস্টবিন পুনরায় স্থাপন করা হবে, এ বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা দিতে পারেননি ডিএনসিসি’র এই কর্মকর্তা। রাজধানীর অন্যতম জনবহুল এলাকা কাওরানবাজারে বাণিজ্যিক স্থাপনার পাশাপাশি রয়েছে সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস। এখানে বৃহৎ কাঁচামালের আড়তে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মালামাল নিয়ে আসে শ শ ট্রাক। এতে এলাকাটিতে তীব্র যানযটের সৃষ্টি হয়। নগরীর প্রধান সড়ক দিয়ে এসব ট্রাক আসায় রাতে যানজট বাড়ে সড়কে। নগরবাসীর এই ভোগান্তি কমাতে কাওরানবাজারের কাঁচা মাল বেচাকেনা কার্যক্রম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন আনিসুল হক। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন শিগগিরই এ এলাকার কাঁচাপণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার। এ কাঁচাবাজার সরানোর এখন আর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, আমিনবাজারের কাঁচাবাজারের কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। মার্কেটটি পুরোপুরি প্রস্তুত হলেই কারওয়ানবাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্পও হাতে নিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু সরজমিনে দেখা যায়, র‌্যাব-১ অফিস ও উত্তরা রাজলক্ষ্মী বাদে আর একটি ইউলুপ নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি এখনো। পুরো প্রকল্পের কাজ এখনো সাইনবোর্ড টাঙানো পর্যন্ত হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রকল্প পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সিটি করপোরেশনের জায়গার পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমি ব্যবহার প্রয়োজন। প্রকল্পের শুরুতে কেউ জমি দিতে আপত্তি না করলেও, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে কাজ করতে হবে বলে এখন ঝামেলা শুরু করেছে। তিনি বলেন, জায়গা হস্তান্তর বা ব্যবহারের অভাবে প্রকল্প কাজ বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত নির্দেশ পেলেই প্রকল্প নির্মাণকাজ আবার শুরু হবে। তবে সব কার্যক্রম শেষ করে কবে নাগাদ এই প্রকল্প নির্মাণকাজ শুরু হবে তা সঠিক করে বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.