খেলাপি ঋণের ভিন্ন প্রেক্ষিত

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে ব্যাংকিং খাত এবং ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ। কয়েকটি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার কারণে সবার চোখ এখন ব্যাংকিং খাতের দিকে। স্বাভাবিক ব্যাংকিং-নিয়মকানুনের বাইরে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি কয়েকটি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকিং খাতে এক বা একাধিক ব্যাংকের বিপর্যয় নতুন বিষয় নয়। বিসিসিআই ব্যাংকের বিপর্যয় ঋণ অনিয়মের কারণে না হলেও এ ব্যাংকটির বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রাহক যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল এবং কয়েকটি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা স্মরণযোগ্য। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের হার আবার ১০ শতাংশ অতিক্রম করল বলে বিষয়টি বেশ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০০ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা ২০১১ সালে ৬.১ শতাংশে নেমে এসেছিল। ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে ২০১২ সালের ঋণশ্রেণিকরণ ও প্রভিশনবিষয়ক নীতিমালায় ঋণ খেলাপি হওয়ার সময়সীমা কমিয়ে আনার কারণে একটি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণের পর অতীতের চেয়ে স্বল্প সময়ে খেলাপিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি একটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৪র্থ প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বর্তমানের তারল্য সংকটের একটা সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকিংয়ে তারল্য সংকট নতুন নয়।
প্রায় এক দশক আগে তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকের ঋণপ্রদানের সক্ষমতা কমে গিয়েছিল, এমনকি অনেক অনুমোদিত ঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতাকে অর্থছাড়ে অনেক ব্যাংককে বাধ্য হয়েই অক্ষমতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের Study on Credit Risk arising in the Banks from Loans Sanctioned against Inadequate Collateral বিষয়ক ২০১৬ সালের একটি সমীক্ষা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০১১ থেকে ২০১৫ এই পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণের গড় হার ছিল সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ২২.৫৬ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ৪.৯ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ৬.৫ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে ২৭.১ শতাংশ। সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায় যে, একই সময়ে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫৫.১ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনা করা যেতে পারে। ২০১৬ সালে ভারতের হার ছিল ৭.৬ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৩ শতাংশ, আফগানিস্তানে ১৫ শতাংশ, ভুটান, পাকিস্তান আর মালদ্বীপে ১১ শতাংশের ওপরে। ভারতে ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হয় মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৬ মাস পর, যা বাংলাদেশে ৩ মাস। বাংলাদেশে ৯ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই মন্দঋণ হিসাবে পরিণত হওয়ার বিধান রয়েছে। ভারতে নিরীক্ষা দল কর্তৃক মন্দঋণ ঘোষণার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে ২০১২ সালে ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালা জারি করার পর ২০১৬ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৮.১ শতাংশ, অন্যদিকে বিতরণ বেড়েছে ৫০.৪০ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের জন্য একটা ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। একটি ঋণ খেলাপি হওয়া পর্যন্ত অনেক স্তর অতিক্রম করতে হয়। গ্রাহকের ঋণের আবেদন, আবেদন পর্যালোচনা, গ্রাহকের ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থা, বর্তমান দায়দেনা এবং গ্রাহকের আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সমীক্ষা, ঋণ ঝুঁকি বিশ্লেষণ, ঋণ অনুমোদন, অনুমোদনপত্র প্রদান এবং গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, ঋণ প্রদান, ঋণ মনিটরিং করা। প্রতিটি স্তরে ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের একটা কার্যকর সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে কোনো বিচ্যুতি, বিচ্ছিন্নতা, অদক্ষতা, খামখেয়ালিপনা বা অনৈতিকতার সৃষ্টি হলে এবং গ্রাহক যদি ব্যাংকিং নিয়মনীতির বিষয়ে অজ্ঞ থাকে বা অর্থলোপাটের পরিকল্পনা করে, ব্যবসায় ব্যর্থতা, ক্ষতি বা বিপর্যয় রোধ করতে ব্যর্থ হয়, এরূপ কারণগুলো একটি ঋণকে খেলাপিতে পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালের সমীক্ষায় ঋণখেলাপি হওয়ার বেশকিছু কারণ নির্ণয় করেছে। যেমন ঋণের উচ্চ সুদ ও মাশুল, বিলম্বে ঋণ অনুমোদন, ঋণের সময় না বাড়ানো অথবা নতুন ঋণ প্রদান না করা, ঋণগ্রহীতার ঋণের শর্ত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া, মনিটরিংয়ের দুর্বলতা, অর্থ স্থানান্তর, ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নে অবহেলা, ইচ্ছাকৃত খেলাপি, অতিরিক্ত কিস্তি এবং অপর্যাপ্ত সময় নির্ধারণ, চলতি মূলধনের জন্য নেয়া ঋণ দিয়ে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে ব্যাংকিংয়ে চরম প্রতিযোগিতা, ব্যাংকের অবাস্তব মুনাফার টার্গেট, অন্য ব্যাংকের ঋণ ক্রয় করা, সরকারি নীতিমালার পরিবর্তন এবং উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০১২ সালের বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৪, তারিখ ২৩.০৯.২০১২-এর মাধ্যমে ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং বিষয়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে বিষয়ে নতুনভাবে সমীক্ষা প্রয়োজন। সব খাতের ব্যবসার জন্য একই ধরনের ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু যৌক্তিক তা নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। একটি ঋণকে খেলাপি হিসেবে ঘোষণার পূর্বে ঋণটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে যাতে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় ঋণটি অর্থ স্থানান্তরের কারণে, নাকি ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে অকার্যকর হয়েছে। এটাও মূলায়ন করা প্রয়োজন যে, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের যৌক্তিক চাহিদা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল কিনা। একটি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলকৃত না হওয়া পর্যন্ত গ্রাহক বিদ্যমান সব ঋণ সুবিধাসহ নতুন কোনো সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। ফলে গ্রাহক খেলাপি ঋণের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে। প্রথমত, ব্যাংক নতুন কোনো সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না। দ্বিতীয়ত, অন্য কোনো ব্যাংক তাকে সহযোগিতা করে না। ঋণ পুনঃতফসিল করা সম্ভব হলেও তা পরিশোধের জন্য নতুন যে সময়সীমা নির্ধারণ করার বিধান রয়েছে, সেই সময়সীমা ঋণগ্রহীতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয় বলে ওই ঋণগ্রহীতার পুনরায় ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যাংকগুলো রেগুলেটরি বাধ্যবাধকতার ভারে জর্জরিত। ব্যাংকারদের জন্য মুনাফার চাপ এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের স্বল্পতায় রেগুলেটরি বাধ্যবাধকতা পরিপালনে অনেক শৈথিল্যের সৃষ্টি হয়, যা ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলে। মানবসম্পদই সব ব্যাংকিং ঝুঁকি দেখভাল করে থাকে। বিশ্বের অনেক বিশ্লেষক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে ব্যাংকিং খাতে একটি অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর তাই খেলাপি ঋণ হ্রাসে একটি মৌলিক ব্যবস্থা হিসেবে সঠিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনসম্পদ তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে ব্যাংকগুলো এখন এক বিশাল ডাটা ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ বিশাল ডাটা ভাণ্ডারের ডাটাগুলো বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঋণ ঝুঁকি হ্রাস করা, ঋণমান উন্নত রাখা এবং মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক? সব খাতের ব্যবসার ধরন ও মুনাফার হার, ব্যবসা চক্র (business cycle), বাজার পদ্ধতি, উৎপাদন খরচ, মূলধন, কাঁচামাল, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজনীয়তা সমরূপ নয়। এ বিষয়ে খাতওয়ারি তেমন কোনো সমীক্ষা বা গবেষণা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের নিত্যপরিবর্তনশীল অবস্থা সম্পর্কে ব্যাংকারদের কাছে আপডেট কোনো তথ্য থাকে না।
আর তাই বেশিরভাগ ব্যাংকারের ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে ঋণ মনিটরিং পর্যন্ত সাধারণ ধারণা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় যা ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বিষয়ে নিয়মিত সমীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে ব্যাংকারদের কাছে আপডেট তথ্যের সহজ প্রাপ্যতার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান আইন ছাড়াও নতুন নতুন ব্যবস্থার বিধান রাখা প্রয়োজন। ভারতে ওয়ান স্টপ সেটেলমেন্ট পদ্ধতিতে ঋণের একটি অংশ আদায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে একাধিক ব্যাংকে একই গ্রাহকের খেলাপি ঋণ থাকলে জয়েন্ট লেন্ডারস ফোরাম গঠনের বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে। এছাড়াও ভারতে কোনো বড় ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ অন্যত্র স্থানান্তর করেছে কিনা, তা অনুসন্ধানের জন্য ঋণের ফরেনসিক অডিট করা হয়ে থাকে। কেপিএমজি ও পিডব্লিউসির মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া কর্তৃক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে একটি খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যাবে, যা ঋণ পুনঃতফসিল, পুনঃগঠন কিংবা পুনঃঋণসুবিধা প্রণয়নে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। অথবা অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করা হলে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা যাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের বিদ্যমান আইনগত ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যেসব আইনগত ব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষণ রয়েছে, তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে নানারকম সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হয়। ব্যাংকগুলোকে তাদের অর্থ আদায়ের জন্য গ্রাহক কর্তৃক সহ-জামানত হিসেবে প্রদত্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিজ কর্তৃত্বে এনে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করার বিধানটি আরও বাস্তবসম্মত করা হলে ঋণ আদায়ে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
মকসুদুজ্জামান লস্কর : ব্যাংকার; অর্থনীতি, ব্যাংকিং ও উন্নয়নবিষয়ক লেখক
laskardhaka@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.