‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’ by মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৬৬ সালের শেষ দিকের কথা। ছয় দফা দাবির পক্ষে এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলার কারণে ইত্তেফাক পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান একনায়কতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দিলেও অন্য শাসকদের তুলনায় উদারমনের আধুনিক মানুষ ছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল যুগপৎ তেতো ও মিষ্টি। সম্পাদকদের সঙ্গে তিনি মাঝেমধ্যে বৈঠক করতেন। সেখানে হাসি-ঠাট্টাও চলত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সুবেদার মোনায়েম খান ছিলেন ঠিক বিপরীত মেরুর মানুষ। একটা স্নাতক ডিগ্রি থাকলেও কথাবার্তায় ছিলেন অমার্জিত, রুক্ষ। তিনি সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে ইত্তেফাক বন্ধ করে দিতে চাইলেন। সরাসরি পত্রিকাটি নিষিদ্ধ না করে তিনি এর ছাপাখানা, অর্থাৎ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস সিলগালা করে দিলেন। সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকালেন। ফলে ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল। ইত্তেফাক দুই বছরেরও কিছু বেশি সময় আলোর মুখ দেখেনি। পত্রিকাটি বন্ধ করেও মোনায়েম ক্ষান্ত হননি। ওই সময় তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমি তখন স্কুলে পড়ি। তাঁর ভাষণ শোনার সুযোগ হয়েছিল। ইত্তেফাককে গালাগাল করতে গিয়ে একপর্যায়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন: ইত্তেফাক-চিচিং ফাঁক। গণমাধ্যমের সঙ্গে শাসকদের আড়াআড়ি কোনো নতুন বিষয় নয়। সরকার নিজের ঢোল নিজেই পেটাতে চায়। এ জন্য পাকিস্তানে তৈরি হয়েছিল প্রেস ট্রাস্ট। এর আওতায় ঢাকায় দুটি দৈনিক পত্রিকা বের হতো-মর্নিং নিউজ আর দৈনিক পাকিস্তান। দুটিতেই বেশ কয়েকজন মেধাবী সাংবাদিক জুটেছিলেন। সরকারি নীতির বাইরে গিয়ে তাঁরা অনেক সময় স্বাধীনভাবে লেখালেখি বা সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করতেন। এ জন্য কারও চাকরি গিয়েছে বলে শুনিনি। ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হলাম ঠিকই, কিন্তু গণমাধ্যমকে সরকার সব সময়ই নিজের ঢোল পেটানোর বাহন হিসেবেই দেখতে চেয়েছে। সরকারের অসহিষ্ণুতার প্রথম কোপটা পড়েছিল আবদুস সালামের ওপর। তিনি ছিলেন দ্য বাংলাদেশ অবজারভার-এর সম্পাদক। ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ হিসেবে এই দৈনিকটি তখন সরকারি মালিকানায় চলছে।
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ অবজারভার-এ ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’ নামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল। ন্যাপের নেতা মোজাফফর আহমদের দেওয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র থাকতে পারে না এবং সত্যিকার ক্ষমতা সংবিধান ও আইনি শৃঙ্খলার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়েছিল, ‘ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা সে আগের সরকারগুলোর সময় নিন্দা জানিয়েছিল। স্থায়ী সরকারি চাকরিগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। মোনায়েম খান (পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর) গ্রামের দারোগাদেরও সরাসরি নির্দেশনা দিতেন। আমরা যদি এক মোনায়েম খানের জায়গায় হাজারটা বসাই, তাতে কোনো উন্নতি হবে না।’ সমালোচনা সহ্য করার মতো মন সদ্য স্বাধীন দেশে তখনো তৈরি হয়নি। আবদুস সালাম বরখাস্ত হলেন। উল্লেখযোগ্য, ১৯৫১ সালে দ্য পাকিস্তান অবজারভার-এ ‘ক্রিপটো ফ্যাসিজম’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় ছাপার ‘অপরাধে’ তখনকার মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত নানা রঙের মুসলিম লীগ দেশ শাসন করেছে। মাঝে বেশ কয়েক বছর ছিল সামরিক শাসন। শাসকদের কঠোর সমালোচনা করে মানিক মিয়া ইত্তেফাক-এ মোসাফির নামে কলাম লিখতেন। এটা ১৯৫৩ সালের কথা। তত দিনে শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী আর ভাসানীর নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ তৈরি হয়ে গেছে। মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের জয়জয়কার। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। নির্বাচনের আগেই বোঝা গিয়েছিল, মুসলিম লীগ এবার কল্কে পাবে না। লীগের নেতাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ ছিল স্পষ্ট। মানিক মিয়া একদিন তাঁর কলামে মুসলিম লীগের নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখলেন, ‘দেখিয়া শুনিয়া মনে হইতেছে, উহাদের চোখে বিড়াল মুতিয়া দিয়াছে।’ এ ধরনের কথা প্রমিত বাংলাতেও এ সময় লেখা কঠিন। মানহানির মামলা হতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময় একটা কথা বলেন, ‘আমরা পত্রপত্রিকায় গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই।’ বিরোধী দলে থাকলে কোনো দল ‘গঠনমূলক সমালোচনা’র কথা মুখেও আনে না। পত্রিকার পাতা ঘাঁটলে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। রাজদণ্ড হাতে থাকলে সমালোচককে তারা সব সময় শত্রু, এমনকি ষড়যন্ত্রকারী মনে করে। সাংবাদিক পেটানো এখন তো নিত্যদিনের সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলতেই হয়। নির্বাচনের আগে থেকেই মূলধারার মার্কিন গণমাধ্যম তাঁর প্রতি বৈরী ছিল। এখনো সুযোগ পেলে তাঁকে তুলাধোনা করতে ছাড়ে না। ট্রাম্প কিন্তু তাঁর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে বৈরী সাংবাদিকদের ছেড়ে কথা বলছেন না। ‘মিথ্যা সংবাদ’ পরিবেশনার ‘কৃতিত্ব’ দেখানোর জন্য তিনি তাঁদের পুরস্কার দেবেন বলেছেন। তিনি হামলা-মামলার পথে হাঁটেননি। ও দেশে যেটুকু গণতন্ত্রের চর্চা হয়, তাতে করে প্রেসিডেন্টকে সব সময়ই সমালোচনা সহ্য করতে হয়।
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যতই আত্মম্ভরী হন না কেন, তিনি নিজেকে রাজা-বাদশাহ মনে করেন না। সরকার অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে। কোনো কোনো সরকারের সময় উন্নয়নকাজ হয় বেশি, কোনো সময় কম। রাজনীতির প্রতিযোগিতার বাজারে কে কত বেশি উন্নয়নবান্ধব, তা তাঁরা ফলাও করে বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। সরকারি দল আশা করে, গণমাধ্যম সব সময় তাদের প্রশংসা করুক। কথাটা এভাবে বলে যে শুধু সমালোচনা না করে আমাদের ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করে না কেন? কেন নেতিবাচক সংবাদ দিয়ে পত্রিকার পাতা ভরায়? তারা এটা বুঝতে চায় না যে উন্নয়ন করা সরকারের দায়িত্ব। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে, এটাই মানুষ আশা করে। ভুল হলে, ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ সমালোচনা করবে এবং গণমাধ্যমে তা প্রতিফলিত হবে। গণমাধ্যমের ভাষা আর সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা ক্রোড়পত্রের ভাষা তো এক রকম হবে না? বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’। এই শিরোনামে তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা ছাপা হয়েছিল। তাঁর লেখা ও কথা ক্ষমতাসীনদের অনেকেই সহজভাবে নেননি। কেউ কেউ তাঁর আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁরা অনেকেই জানেন না, আমাদের রাষ্ট্রের নাম ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এ নামটি তিনিই দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, যখন দিল্লিতে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি হচ্ছিল। ইতিহাসে রেহমান সোবহানরা টিকে থাকবেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.