প্রশ্ন নিয়ে কিছু জরুরি প্রশ্ন by আমিরুল আলম খান

হালে দেশের মানুষ দুটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বলে আমার বিশ্বাস। দুটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের শিক্ষা এবং আর্থিক খাত ভেঙে পড়েছে। আমি আদার বেপারী, তাই আর্থিক খাত নিয়ে কথা বলব না। আমার আলোচনার বিষয় ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা। ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষার সব প্রশ্নের বহু নৈর্বাচনিক অংশ এবার আগেভাগেই ফাঁস হয়েছে। ফলে গোটা পরীক্ষাই প্রশ্নবিদ্ধ। স্বীকার করতেই হবে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সবাই পায়নি, পেয়েছে অল্প কিছুসংখ্যক পরীক্ষার্থী। ফলে সুযোগের সমতা বিনষ্ট হয়েছে। এখন পরীক্ষার ফলে এর যে প্রভাব পড়বে, তা হবে অত্যন্ত মারাত্মক। সবচেয়ে বেশি সংকট হবে আস্থার। এ বছর যারা পাস করবে, বিশেষ করে যাদের ফল ভালো হবে, তাদের সবাইকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাদের গায়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের গন্ধ লেগে থাকবে। প্রশ্ন ফাঁসের কোনো সুযোগ না নিয়েও সারা জীবন অনেককেই এই অপবাদ সহ্য করতে হবে; কিন্তু কোন অধিকারে তাকে দায়ী করব আমরা? বেশ কিছুকাল ধরে বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে হুটহাট সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। কেন এমন হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তার কোনো সন্তোষজনক জবাব জাতি জানতে পারছে না। কোনো রকম বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়াই কিছু অতি উৎসাহী মানুষ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দিচ্ছে আর তার মূল্য দিয়ে চলেছে দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু ভুল কাজের জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হচ্ছে না। শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা দুটি ভিন্ন বিষয়। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। অন্তত আগামী ৫০ বছরে দেশি ও বৈদেশিক চাহিদা অনুমান ও বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষার ভিত তৈরি করতে হয়। শিক্ষার ভিত্তি হলো কারিকুলাম। সে কারিকুলামের লক্ষ্য অর্জনে তাকে ভাগ করা হয় শ্রেণিভিত্তিক সিলেবাসে। কাজটি খুবই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। তাই পৃথিবীর কোনো দেশেই কারিকুলাম-সিলেবাসে যখন-তখন হস্তক্ষেপ করা হয় না। বিশেষজ্ঞরা এসব নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেন এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, পরিবর্তন, বর্জন ইত্যাদি করে থাকে। শিক্ষার কোন স্তরে কী পড়ানো হবে, কতক্ষণ পড়ানো হবে, কীভাবে পড়ানো হবে, কীভাবে শিখনফল যাচাই করা হবে, কোন ধরনের প্রশ্ন করে তা যাচাই করা হবে, কোন কর্তৃপক্ষ কীভাবে তা যাচাই করবে, সে জন্য কত সময় ও নম্বর বরাদ্দ করা হবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা থাকে সিলেবাস-কারিকুলামে। তাই কারিকুলাম ও সিলেবাসকে বলা হয় শিক্ষার মস্তিস্ক। আমাদের দেশে নব্বই দশকে বহু নির্বাচনী নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া চালু হয়। প্রথমে ৫০০ প্রশ্নের একটি প্রশ্নব্যাংক করে তা থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন বহু নৈর্বাচনিক প্রশ্নে নম্বর ছিল ৫০। তার ফল শুভ হয়নি। পরে প্রশ্নব্যাংক উঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে বহু নৈর্বাচনিক প্রশ্ন উঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে আবার চালু করা হয়। মোট নম্বরের ৪০ ভাগ ছিল বহু নির্বাচনী প্রশ্ন। এখন তা ৩০ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হয়। এবার মাধ্যমিক প্রশ্নের ৭০ ভাগ ছিল সৃজনশীল। কিন্তু শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই এ পদ্ধতি চালু করায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারছেন না। অভিভাবকরাও সন্তানদের পড়ায় সাহায্য করতে পারছেন না। ফলে দেশে নোট-গাইডের বান ডেকেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস। এবার নাকি শুধু বহু নির্বাচনী নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। সৃজনশীল অংশ নাকি ফাঁস হয়নি। এ বিষয়টি নিরপেক্ষ ও নিরাসক্তভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রত্যেক বিষয়ে বহু নৈর্বাচনিক প্রশ্ন করা হয় চার সেট। সেখানে একই প্রশ্নের ক্রমপরিবর্তন করে দেওয়া হয়, যাতে পরীক্ষা হলে পরস্পর বলাবলি করে কেউ উত্তর দেওয়ার সুযোগ না নিতে পারে। ধরা যাক, বাংলার কোনো পত্রের বহু নির্বাচনী প্রশ্ন ফাঁস হলো। তাহলে যদি চার সেট প্রশ্নই ফাঁস না হয়, তার যে সমাধান দুর্বৃত্তরা সরবরাহ করবে, সে উত্তর এক-চতুর্থাংশ পরীক্ষার্থীর কাজে লাগলেও বাকিদের উত্তর ভুল হবে এবং কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে মূল্যায়নের ফলে সেই ভুল সংশোধনের কোনো উপায়ও থাকবে না। মিডিয়ায় বহু নির্বাচনী প্রশ্ন ফাঁসের যেসব খবর বেরিয়েছে, তাতে আমরা নিশ্চিত নই চার সেট প্রশ্নই ফাঁস হয়েছে কিনা। এদিকে এটা বলা হচ্ছে যে, সৃজনশীল প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তাই দাবি উঠেছে, বহু নৈর্বাচনিক প্রশ্ন বাদ দিতে হবে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৯ সাল থেকে মাধ্যমিকে ৩০ নম্বরের বহু নির্বাচনী অংশ থাকবে না। তবে কি আগামী বছর থেকে শতভাগ সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হবে? আগামী বছর যদি সৃজনশীল প্রশ্ন ফাঁস হয়, তখন কি সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দেওয়া হবে? এমন সিদ্ধান্ত স্রেফ মূর্খতা। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস কি পদ্ধতিগত সমস্যা? আমি মনে করি, এটি একটি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা। তার সঙ্গে যুক্ত মূল্যবোধ বা নৈতিকতার সংকট। আরও স্পষ্ট করে বললে, দুর্নীতির সীমাহীন বিস্তারের সমস্যা। কিন্তু কিছু লোক পরামর্শ দিচ্ছেন, বহু নৈর্বাচনিক পরীক্ষা ব্যবস্থাই এ জন্য দায়ী। এ দেশে তো সরকারি কর্মকমিশন থেকে সব চাকরিক্ষেত্রে বহু নৈর্বাচনিক অভীক্ষা নেওয়া হয়। তাহলে শিক্ষার্থীদের বহু নির্বাচনী প্রশ্নে দক্ষ করে তোলা হবে না কোন যুক্তিতে? এই পদ্ধতির সুবিধা, অসুবিধা দুটিই আছে। কারও কারও মতে, এ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ত্রুটি এটা অনেকটা স্মৃতিনির্ভর। কিন্তু স্মৃতিতে ধারণ করা শিক্ষাক্ষেত্রে অস্বীকৃত কোনো পন্থাও নয়। এমনকি ব্লুম টেক্সোনমিতে ১৯৫৬ সালে যাকে 'জ্ঞান' বলা হয়েছিল স্বয়ং ব্লুমের নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে তা সংশোধন করে 'স্মরণ করা' বলা হয়েছে এবং ২০০১ সাল থেকে তার চর্চাও হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বহু নৈর্বাচনিক অভীক্ষার আরেকটি বিপদ হলো, পরীক্ষার্থীরা সুযোগ পেলে পরস্পর আলোচনা করে উত্তর দিতে পারে। সেটি প্রতিরোধে একই প্রশ্নের ক্রমপরিবর্তন করে চার সেট আলাদা আলাদা প্রশ্ন তৈরি করা হয়। তাছাড়া এমনভাবে আসন বিন্যাস করে একই সেটের পরীক্ষার্থীদের দূরে দূরে বসানো হয়, যাতে একে অন্যের উত্তর দেখে বা বলাবলি করে উত্তর দিতে না পারে। এ বিষয়ে ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে সুবিধা হলো, এই পদ্ধতিতে সিলেবাসের সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে শিখতে হয়। বহু নৈর্বাচনিক অভীক্ষার কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক সূত্র আছে। সেগুলো অনুসরণ করলে এই অভীক্ষায় শিক্ষার্থীর শিখনফল নৈর্ব্যক্তিকভাবে যাচাই করা যায়। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি অল্প সময়ে সঠিক মূল্যায়ন ও ফলাফল তৈরি করা যায়। তাই সারা পৃথিবীতেই বহু নৈর্বাচনিক অভীক্ষা চালু আছে। কিন্তু আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বহু নৈর্বাচনিক প্রশ্ন তৈরি করা হয় না, যেটি করা জরুরি ছিল। দেখা যাচ্ছে, বহু নির্বাচনী অভীক্ষার দুর্বলতা দূর করার বিজ্ঞানসম্মত উপায় আছে। কাজেই বহু নির্বাচনী অভীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণ নিশ্চয়ই পদ্ধতির ত্রুটি নয়; ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাঘটিত ত্রুটি। তাহলে ব্যবস্থাপনা, মূল্যবোধ বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটির দায় শিক্ষার্থীরা কেন বহন করবে? এর কারণ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ অভাবের। সে দায় শাসন ব্যবস্থার, প্রশাসনের, শিক্ষকের, আইন প্রয়োগে শৈথিল্যের। শিক্ষায় যে কোনো পরিবর্তন করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। কিন্তু এ সম্পর্কে তারা কোনো কথা বলছে না। যেসব জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ বহু নির্বাচনী অভীক্ষা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদের কেউই শিক্ষাবিজ্ঞানী বা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ নন। আমলারাও কেউ কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ নন। আমাদের দেশে শিক্ষাকে বিজ্ঞান বলেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তেমনি পার্থক্য করা হয় না শিক্ষক ও শিক্ষাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও। এখানে জনতুষ্টিবাদের জয়জয়কার। জনতুষ্টিবাদীদের পরামর্শ কোনো সঠিক পথ প্রদর্শনে সফল হয় না। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে শিক্ষার্থী ও জনমনে নিদারুণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাজ করছে। সে কারণে শতভাগ সৃজনশীল প্রশ্ন জনচিত্তে ক্ষোভ সঞ্চার করতে পারে। আমরা মনে করি, বহু নির্বাচনী অভীক্ষা পুরোপুরি তুলে দেওয়া সঠিক নয়। তবে নম্বর কিছু কমিয়ে ১৫ থেকে ২০ করা যায় কিনা সে বিষয়ে শিক্ষাবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। যা কিছুই করা হোক, তা করতে হবে যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের পরামর্শে ও ধীরেসুস্থে; তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত বুমেরাং হতে বাধ্য।
amirulkhan7@gmail.com
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.