আইনের শাসন থাকলে উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন by খন্দকার মাহবুব হোসেন

বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের যেসব নেতাকর্মী এতদিন রাজনীতিতে নিশ্চুপ ছিলেন, তারা কিন্তু এখন খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, খালেদা জিয়ার দণ্ড হলে বিএনপি নেতাকর্মীরা সারাদেশে বিশৃঙ্খলা করবে, ভাংচুর করবে। তখন সেটার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আরও ভাংচুর চালিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করবে, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশের কোথাও বিশৃঙ্খলা না করে বিএনপির নেতাকর্মীরা অহিংস আন্দোলনে গিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বরং খালেদা জিয়ার এই দণ্ডাদেশ আগামী নির্বাচনে বিএনপির জন্য ইতিবাচক হয়ে দেখা দেবে
সমকাল : দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ডিত হওয়ার বিষয়টিকে আইনজ্ঞ হিসেবে কীভাবে দেখছেন?
খন্দকার মাহবুব : দুর্নীতির মামলায় রাজনীতিবিদদের দণ্ডিত হওয়া নতুন কিছু নয়; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও কিন্তু কয়লার পারমিট সংক্রান্ত একটি মামলায় (১৯৫৪-৫৫ সালে) দুই বছরের সাজা হয়েছিল। যদিও উচ্চ আদালতে সেটি টেকেনি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ধরনের মামলা আমরা দেখি। অবশ্য খালেদা জিয়ার মামলাটি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে অনেক মামলা করেছিল। গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ শেখ হাসিনার সব মামলা প্রত্যাহার ও খারিজ (আদালতে) হলেও খালেদা জিয়ার মামলাগুলো এখনও চলছে। এ রকম একটি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। আইনের শাসন থাকলে উচ্চ আদালতে তিনি খালাস পেয়ে যাবেন।
সমকাল :খালেদা জিয়ার দণ্ডের ফলে বিএনপির রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি-না?
খন্দকার মাহবুব :বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের যেসব নেতাকর্মী এতদিন রাজনীতিতে নিশ্চুপ ছিলেন, তারা কিন্তু এখন খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, খালেদা জিয়ার দণ্ড হলে বিএনপি নেতাকর্মীরা সারাদেশে বিশৃঙ্খলা করবে, ভাংচুর করবে। তখন সেটার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আরও ভাংচুর চালিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করবে, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশের কোথাও বিশৃঙ্খলা না করে বিএনপির নেতাকর্মীরা অহিংস আন্দোলনে গিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থাৎ দেশকে অস্থিতিশীল করতে আওয়ামী লীগের ফাঁদে বিএনপি পা দেয়নি। বরং খালেদা জিয়ার এই দণ্ডাদেশ আগামী নির্বাচনে বিএনপির জন্য ইতিবাচক হয়ে দেখা দেবে। এ দণ্ডের কারণে বিএনপি দলগতভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যদিও এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি (খালেদা জিয়া) কারাগারে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। তবে এতে তার প্রতি সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সহানুভূতি বেড়ে গেছে।
সমকাল :দণ্ডিত হওয়ার কারণে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে যদি বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হয়, বিএনপির অবস্থান কী হবে?
খন্দকার মাহবুব :খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ দেখি না। সরকারকে বলব, প্রতিহিংসা বাদ দিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে যাতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য পদক্ষেপ নিন। তাহলে উভয় দল ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে।
সমকাল :দুর্নীতির দায়ে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ ও বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্‌হাবের পদত্যাগের ঘটনা বিচার বিভাগে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলেছে কি?
খন্দকার মাহবুব :এ দুটি ঘটনায় বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়কে ঘিরে এ পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে যদি সত্যিই দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, তাহলে তারও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। নয়তো জনমনে বিভ্রান্তি থাকবে যে, ওই (ষোড়শ সংশোধনী) রায়ের কারণে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সমকাল :আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় বর্তমান সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন করুন।
খন্দকার মাহবুব : দুইজন বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। এটি অবশ্যই ন্যক্কারজনক। তা ছাড়া ৩৩ লাখ মামলাও বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন। এর মধ্যে হাইকোর্টে মামলার সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। সরকারের উন্নয়নের ঢাকঢোল আমরা যেভাবে শুনতে পাই, সে অনুযায়ী যদি উন্নয়ন হতো তাহলে উপযুক্ত সংখ্যক বিচারক ও সহায়ক জনবল বিচার বিভাগে নিয়োগ করা হতো। সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগ সর্ম্পূণভাবে অবহেলিত এবং বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়নি।
সমকাল :দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৮শ' জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
খন্দকার মাহবুব :দুর্নীতির মামলায় ৮শ' লোকের সাজা হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু যেখানে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে; সেখানে ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কারও দুর্নীতির দায়ে সাজা না হওয়াটা দুঃখজনক। তাদের বিচার নিশ্চিত না করে ৮শ' দুর্নীতিবাজের বিচার করে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে না।
সমকাল :তিন বছর ধরে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ হয়নি; স্বাধীনতার পর থেকেই আইন প্রণয়ন ছাড়াই বিচারক নিয়োগ হচ্ছে- এ দুটি বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?
খন্দকার মাহবুব :আমি চারবার সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি এবং দু'বার বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়্যারমান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। প্রতিবার উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য নীতিমালা করার জন্য সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি; কিন্তু হয়নি। অবিলম্বে এই নীতিমালা হওয়া উচিত।
সমকাল :প্রস্তাবিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৩২ ধারা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের আপত্তির বিষয়ে আপনার মতামত কী? এই ধারা থাকা উচিত কি-না? এর বিকল্প কী হতে পারে?
খন্দকার মাহবুব :প্রস্তাবিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৩২ ধারা পূর্বের ৫৭ ধারার অনুরূপ। বরং ৩২ ধারা কার্যকর হলে আরও বেশি করে গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতা হরণ করবে। যেসব অপরাধের ক্ষেত্রে ৩২ ধারা প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে, তা প্রেস কাউন্সিল আইনে সংযোজন করে এবং ওই আইনের আওতায় নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সমকাল :আইন অঙ্গনের দুর্নীতি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকে কীভাবে দেখছেন? বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
খন্দকার মাহবুব :বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যে বক্তব্য রেখেছেন তা প্রশংসনীয়। আমি আশা করব, প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এতে বিচারপ্রার্থী অনেক হয়রানি থেকে রক্ষা পাবেন। তবে মনে রাখতে হবে, এই দুর্নীতির পেছনে যে মামলাজট রয়েছে, তা দূর করার জন্য দক্ষ ও যোগ্য বিচারকের পাশাপাশি সহায়ক জনবলও নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মামলাজটের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে না পারে। পুলিশ প্রশাসন ঢালাওভাবে মামলা দায়ের করাও মামলাজট বাড়ার কারণ। এ জন্য মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে হবে এবং তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল :নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এর সমাধান কীভাবে সম্ভব?
খন্দকার মাহবুব :তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রয়েছে, সে কারণে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা ব্যতীত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা হিসেবে এখন (প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচন) যেটি সংবিধানে রয়েছে, তা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলই প্রবর্তন করেছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে যেটা সম্ভব ছিল; বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের এখন যে মনোভাব, তাতে একতরফাভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিকভাবেও এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সমঝোতার ভিত্তিতেই নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি ঠিক করতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, সে জন্য তাদেরকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপি অতীতের ভুলভ্রান্তি ভুলে গিয়ে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চায়।
সমকাল :২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনকালীন সরকারের থাকার জন্য বিএনপিসহ কয়েকটি দলকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তখন বিএনপি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল তা গ্রহণ করে নির্বাচনে অংশ নেয়। বতর্মান পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অনুরূপ প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাহলে বিএনপির সিদ্ধান্ত কী হবে?
খন্দকার মাহবুব :সরকারের কাছ থেকে আবারও প্রস্তাব চাচ্ছি। প্রস্তাব দিলে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেব। একতরফা নির্বাচন এবার হতে দেওয়া হবে না।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :আবু সালেহ রনি

No comments

Powered by Blogger.