তিন নোবেল-কন্যার সফর আর কতিপয় ‘প্রশ্ন’ by গওহার নঈম ওয়ারা

তাঁরা তিনজনই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, তিনজনই নারী। গত সপ্তাহে তিনজন একসঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির সরেজমিন পরিদর্শন করলেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই তিন নারী: ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান, ইরানের শিরিন এবাদি এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের ম্যারেইড ম্যাগুয়ার। উখিয়া থেকে ফেরার পথে এই লেখক তাঁদের গাড়ির ধুলা আর কোটালদের চাহনি ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি। সন্ধ্যায় কক্সবাজারে রিলিফ কমিশনারের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় নোবেল-কন্যাদের প্রসঙ্গ উঠল, মনে হলো সবাই যেন অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো দেখছেন—এবার নিশ্চয় কিছু হবে! শরণার্থীনেতারও যেন মনে হলো মনে জোর পাচ্ছেন, হাজার হোক সুকির (মতান্তরে সু চি) বন্ধুরা এসেছেন। বাংলাদেশ সফরে আসা তিন নারী নোবেলজয়ীর মতো সু চিও তো নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী। সু চি নিশ্চয় তাঁর একসময়কার সতীর্থদের খালি হাতে ফেরাবেন না! রোহিঙ্গাদের সামাজিক নেতাকে বলে মাঝি। এ রকম একজন মাঝির স্ত্রী ভেবেছিলেন, সফররত অতিথিরা কক্সবাজার-ঢাকা ঘুরে নেপিডো, সিটুইয়া হয়ে মংডু বুছিডং যাবেন। বলা বাহুল্য, এটা নিছকই তাঁর ধারণাপ্রসূত কল্পনাবিলাস। বাস্তবে তা ঘটেনি, কখনো ঘটবে কি? কী জানি? এই প্রশ্নটাই করা যেত ম্যারেইড ম্যাগুয়ারকে কিংবা তাওয়াক্কল কারমান অথবা শিরিন এবাদিকে। তাওয়াক্কল আর শিরিন দুজনেই যাঁর যাঁর দেশ থেকে নির্বাসিত—পরবাসী। চাইলেই তাঁদের নিজেদের দেশে তাঁরা ফিরতে পারবেন না। কিন্তু ম্যারেইড ম্যাগুয়ারের পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি তাঁর দেশেও সমাদৃত, সরকার অ-সরকার সবাই তাঁকে পাত্তা দেয় কথা শোনে। তিনি কি একবার চেষ্টা করবেন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের পোড়া ভিটা আর গণকবর সরেজমিন দেখে আসতে? কিংবা নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভ কি একবার উড়োজাহাজটা ওদিকে ঘুরাবে? কিংবা এরপর কী ঘটবে? গত ১ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো পত্রিকা লিখেছে, ‘তিন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ থেকে ফিরেই তাঁরা মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করবেন। উদ্দেশ্য, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কৈফিয়ত চাওয়া আর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। যদিও চিঠির পর চিঠি লিখেও সু চির কোনো জবাব তাঁরা পাননি। তবু তাঁরা হাল ছাড়বেন না। চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কী করতে হবে, সেই সুযোগ এসেছিল ঢাকায় এই তিন মহীয়সী নারীকে নিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায়। আয়োজন করেছিল নারীদের সংগঠন নারীপক্ষ। তাদের গণদাওয়াতের লম্বা তালিকায় কীভাবে যেন ঢুকেছিল আমাদের নামও। শুধুই ঘোরাফেরা, চা, শরবত, বক্তৃতা-বিবৃতি, কান্নাকাটি, জড়িয়ে ধরা, ফোটোসেশন জমিলা-করিমা-আবেদিন-উমাদের ঘরে ফেরা নিশ্চিত করবে কি না? এসব অনেক প্রশ্ন করা যেত নোবেল বিজয়ী নারীদের। আয়োজকেরা সুযোগও দিয়েছিল। কিন্তু ওই যে রবিঠাকুরের অমোঘ বাণী: ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’, তা কি কখনো মিথ্যা হতে দেবে বাঙালি? কথা ছিল প্রশ্নকর্তা ও প্রশ্নকর্ত্রীরা শুধু নিজ নিজ নামটা বলে প্রশ্ন করবেন, সংক্ষেপে শুধুই প্রশ্ন। কিন্তু হুজ্জতে বাঙালি হাতে মাইক পেলেই অমায়িক হয়ে যান, প্রশ্ন ভুলে পারলে পুরো ১০ মিনিটের ব্যাখ্যাসহ রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়ে দেন আরকি! সঞ্চালক প্রমাদ গোনেন, লজ্জা ধুয়ে ফেলে চিৎকার করেন, প্রশ্ন করেন।
কিন্তু কে কার কথা শোনে! কে কত আগে থেকে নোবেল-নারীদের সম্পর্কে জানেন, তাঁদের ছবি টাঙিয়েছেন মনের চাতালে, ছুঁয়ে দেখেছেন কোন এয়ারপোর্টে কোন সেমিনারের পরে লম্বা লাউঞ্জে, সেসবের ফিরিস্তি আর শেষ হয় না। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আসল প্রশ্নগুলো তেমন করে আর করাই হয় না। সারা আরব বিশ্ব সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার উজাড় করে দিয়ে এক পুরুষ শ্রোতা জানতে চাইলেন, আপনি কবে ইয়েমেনের নারীদের হিজাব খুলতে বলবেন? কেউ এভাবে কথা বলে? লজ্জা লজ্জা! সীতা ওখানে থাকলে হয়তো বলতেন, ধরণি দ্বিধা হও, আমি মুখ লুকাই। ইয়েমেনের শান্তিবাদী নারী তাওয়াক্কল না চটে জানিয়ে দিলেন, পোশাক নয় ভাই, কাজ দিয়ে বিচার করুন। হিজাব চাপিয়ে দেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি কাউকে হিজাব খুলতে বাধ্য করাটাও অন্যায়। আরেক ‘ভাই’ হুজ্জতি দেখাতে গিয়ে পড়লেন মহাফাঁপরে। তাঁর বীরত্বের গাথা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা ফাঁসি দিয়ে তবে ছেড়েছি, আন্দোলন করে সেটা হাসিল করেছি!’ ইরানের শিরিন এবাদি বললেন, ‘সরি ভাই, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমরা ফাঁসির মতো মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি অনুমোদন করতে পারি না।’ কাজের প্রশ্ন করার সুযোগ এভাবেই বেহুদা হুজ্জতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। যেমন যায় অনেক সময়; সময় নষ্ট হয়েছিল শুরুতেও। যে ভবনে আয়োজন সেই দালানের মালিকদের শখ হয়েছিল শান্তির দূতদের সঙ্গে ছবি তোলার, কীভাবে সেটা করা যায়? গুষ্টি বেঁধে ওদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে করতেই কেটে যায় অনেকটা সময়। না জানি এসব ক্রেস্ট প্রদানের ছবি তাঁরা কত জায়গায় ব্যবহার করবেন; তাতে কি রোহিঙ্গা পরিস্থিতির কোনো হিল্লা হবে? বিদেশি অতিথিদের সামনে নিজেদের যে পরিচয় আমরা কতিপয় দিলাম, তাতে আমাদের না হোক, অতিথিদের নিশ্চয়ই বোধোদয় হবে। নিশ্চয় আমরা এখনো সংশোধনের অতীত হইনি।
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.