চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবে ইরান? by মাসুমেহ্ তোরফে

পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানির ঐতিহাসিক জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তি স্বাক্ষরের পর মনে হচ্ছে ইরান এই প্রথমবারের মতো তাদের কৌশল বদলাতে যাচ্ছে এবং হয়তো চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইরান পরিষ্কারভাবে একটি আলটিমেটাম দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করার পর পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক, কোম্পানি ও বাণিজ্য সংস্থাগুলো তাদের সঙ্গে লেনদেন স্থগিত করে রেখেছে; এটি যদি অব্যাহত থাকে এবং জেসিপিওএ যদি তাদের জন্য আর্থিকভাবে সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা এটি থেকে বের হয়ে যাবে। ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি লন্ডনে চ্যাটাম হাউসে বলেছেন, ‘যে চুক্তি আমাদের জন্য কোনো সুবিধা বয়ে আনবে না, সেই চুক্তিতে আমরা বাঁধা পড়ে থাকতে পারি না।’ আরাগচি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোক এবং জেসিপিওএর মূল আলোচকদের একজন। তাঁর অভিযোগ, ট্রাম্প একটি ‘লন্ডভন্ড অবস্থা’ তৈরি করে ওই চুক্তির ‘আক্ষরিক ও নৈতিক’ সীমা ভেঙে ফেলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কয়েক মাস ধরেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ইরান যদি তার ‘দোষত্রুটি’ থেকে সরে না আসে, তাহলে জেসিপিওএ চুক্তি ভেঙে দেওয়া হবে। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প তাঁর ইউরোপীয় মিত্রদের বলেছেন, ইরান যদি তার আচরণ সংযত না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মে মাসের ১২ তারিখের আগেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আরোপ করা নতুন নিষেধাজ্ঞা পাস করতে পারে। ট্রাম্প এই চুক্তিতে মূলত তিনটি ত্রুটি রয়ে গেছে বলে মনে করছেন। এ কারণেই তিনি চুক্তি থেকে বের হতে চাইছেন। ট্রাম্প মনে করেন, এই চুক্তিতে ইরানের দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম সীমিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি; ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা যখন খুশি পরিদর্শন করতে পারবেন—এমন অনুচ্ছেদ রাখা হয়নি এবং সবশেষে ‘সানসেট’ শীর্ষক একটি অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে, যার আওতায় ১০ বছর পর ইরান পরমাণু কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে বলা হয়েছে।
তবে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য পক্ষগুলো যখন ট্রাম্পের দাবি করা এ বিষয়গুলো চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাখ্যান করে জানাল যে বিষয়গুলো জেসিপিওএর আওতায় পড়ে না; তখন ট্রাম্প নতুন একটি সম্পূরক শর্ত চুক্তিতে জুড়ে দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা ও কার্যক্রম চালানো বন্ধ করা, আইএইএর পরিদর্শন আরও কড়া করা এবং ‘সানসেট অনুচ্ছেদ’-এর ‘ত্রুটিবিচ্যুতি’ ঠিক করা এই চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আব্বাস আরাগচি লন্ডনে চ্যাটাম হাউসে বলেছেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পর ট্রাম্প এখন নতুন যে শর্তগুলো চুক্তির মধ্যে সম্পূরক হিসেবে ঢোকাতে চাইছেন, তা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তিনি বলেছেন, এই চুক্তিতে অস্ত্র বিস্তার রোধের কথা বলা হয়েছে; দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা যাবে কি যাবে না, তা এই চুক্তির আওতার বিষয় নয়। এ ছাড়া আইএইএ পরপর নয়বার ইরানের পরমাণু কার্যক্রম বিশদভাবে পরিদর্শন করেছে। নতুন করে সেখানে তাদের পরিদর্শনের কোনো প্রয়োজন নেই। আরাগচি বলেছেন, ট্রাম্প ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধের যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন, সেটিও ভিত্তিহীন। কারণ, ইরান পরমাণু অস্ত্র না বানানোর ব্যাপারে স্থায়ীভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। খবর পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে কোটি কোটি ডলারের একটি পরমাণু জ্বালানি চুক্তি করতে যাচ্ছে। এর জের ধরেই ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে এতটা খেপে উঠেছেন। চ্যাটাম হাউসে আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে চুক্তিটিকে হত্যা করার পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে। গত জানুয়ারিতে সপ্তাহজুড়ে ইরানে বিক্ষোভ চলার সময় ট্রাম্প যেসব টুইট করেছেন, তা দেখে মনে হবে তিনি ইরানের প্রশাসনে পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন। ট্রাম্পের ইরানবিরোধী কথাবার্তার কারণে বহু বিদেশি ব্যবসায়ী ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত করে রেখেছেন। এতে ইরানে লোকজন কাজ হারাচ্ছেন। কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দেওয়ায় সেখানে বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। চুক্তিতে স্বাক্ষর করা পক্ষগুলো ইরানকে যদি প্রতিশ্রুত অর্থ না দেয়, তাহলে বিক্ষোভ আরও বাড়বে। এ অবস্থায় নিজেদের পিঠ বাঁচাতে হলেও ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াবে। এটি হলে নতুন করে এই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াবে। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী থাকবেন ট্রাম্প।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাসুমেহ্ তোরফে জাতিসংঘের অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন ফর আফগানিস্তানের (ইএনএএমএ) স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন বিভাগের সাবেক পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.