হামলা হয় কয়েক সেকেন্ডে

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানঃ জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতগুলো হয়েছিল দ্রুততার সঙ্গে। সবাই যখন মুক্তমঞ্চের সামনের ভলিবল গ্রাউন্ডে রোবোফাইটে মনোযোগী তখনই ছুরিকাঘাত করা হয়। এতই দ্রুততার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটেছে যে তখন ঘটনাস্থল মুক্তমঞ্চের কাছে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী ছুরিই দেখতে পাননি। জাফর ইকবালকে ঘন ঘন একটার পর একটা কিলঘুষি মারা হচ্ছিল বলে তার দৃষ্টিভ্রম হয়। তার ধারণা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই (হামলাকারী ফয়জুর রহমান) এতগুলো বেকস্টেপ করেছে। তার ওই ভুল ভাঙতে লেগে যায় আরো কয়েক সেকেন্ড।
রক্তাক্ত জাফর ইকবাল উঠে দাঁড়ানোর পরই তার ভুল ভাঙ্গে। দৌড়ে গিয়ে উদ্ধার করেন। গতকাল দুপুরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলন শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঘটনার এই চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী তার দেখা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, মুক্তমঞ্চে ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও অতিথিরা। আমরা কয়েকজন শিক্ষক মুক্তমঞ্চের নিচে রোবোফাইট দেখছিলাম। মঞ্চে স্যারের পেছনে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ। পুলিশের পেছনে এক ছেলে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে স্যারকে পেছন থেকে আঘাত করা শুরু করে। আমি কিছুটা দূরে নিচ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পাই এক ছেলে দ্রুত স্যারকে পেছন থেকে মেরে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল সে বুঝি খুব কিলঘুষি মারছে। প্রথমে স্যারও বুঝতে পারেন নি। যখন বুঝতে পারেন তখন ঘাড় নিচু করে ফেলেন। হাত দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিছুটা সরে যান। উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। তখনই দেখতে পাই স্যারের মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। পরে চিকিৎসকের কাছে জানতে পারি মাথা, পিঠ ও হাতে ৬টা আঘাত করা হয়েছে।
এত কম সময়ের মধ্যে ওই ছেলেটা একটার পর একটা আঘাত করে যাচ্ছিল যে তা অবিশ্বাস্য। তখনও স্যার স্বাভাবিক ছিলেন। আঘাত পেয়ে স্যার যদি না দাঁড়াতেন তা হলে বাঁচতে পারতেন না। সে খুব দ্রুত আরো আঘাত করতো।
তিনি বলেন, অন্য অনুষ্ঠানে সবার চোখ থাকতো মঞ্চের দিকে। আর ওটা ছিল রোবোফাইট। আমাদের দায়িত্ব ছিল মূল্যায়ন। মুক্তমঞ্চে অতিথিরা। আর নিচে ভলিবল গ্রাউন্ডে চলছিল রোবোফাইট। রোবটের যুদ্ধের বিচার হচ্ছিল। তাই সবার চোখ ছিল সেদিকে। এ সময়টাকেই হামলাকারী বেছে নিয়েছিল। যখন সবার চোখ সামনের দিকে তখনই অতর্কিত অবস্থায় ছুরি বের করে হামলা শুরু করে। তখন ওই ছেলে কোনো শব্দ করেনি। স্যারও চিৎকার করেননি। উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন স্যারের মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তখন আমি ও কয়েক ছাত্র স্যারকে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটি নোহা গাড়িতে তুলি। যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল তখনও স্যার বলেন যে, আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি। তোমরা ওই ছেলেকে মেরো না। এমনকি আমাকে স্যার গাড়িতে উঠতে দেননি। বলেন, তুমি গিয়ে দেখো। যেন ওই ছেলেকে মেরে না ফেলে। পরে এসো। ছেলেটাকে নিরাপদ করে তারপর এসো।
তা পূর্বপরিকল্পিত আঘাত হতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি। বলেন, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগিং নিয়ে যে সমস্যা হয়েছিল তার সঙ্গে এই হামলার সম্পৃক্ত না-ও থাকতে পারে। তবে ওই ছেলে হয়তো আগে থেকে এসেছিল এবং পিছু নিয়ে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। হতে পারে প্রশিক্ষিত। সে যদি না হতো তাহলে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এতগুলো আঘাত করতে পারতো না। স্যার আত্মরক্ষার চেষ্টায় ঘাড় নিচু করে সরে যাওয়ায় এবং উঠে দাঁড়ানোয় হয়তো তার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সরে দাঁড়ানোর জন্যই হয়তো তার ঘাড়ে আঘাত লাগেনি। তখন স্যারের হাতে একটা বই ছিল। তখন হামলাকারীর সঙ্গে আর কেউ ছিল না। পেছনে হয়তো থাকতে পারে।
হামলার সময় ড. জাফর ইকবালের পাশে থাকা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে জানান, ‘আমি স্যারের পাশে বসা ছিলাম, এ সময় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেলো। একটি ছেলে এসে স্যারের উপর হামলা করে। তখন স্যারকে দ্রুত ধরার চেষ্টা করি। পরে স্যারকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দেয়া হয়। তখন তাকে সেভ করাটাই আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।’ সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের হাত থেকে হামলাকারীকে রক্ষা করি। ওকে মেরে ফেললে আসল ঘটনা উদঘাটন হবে না। এই জন্য তাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। হামলাকারীর সঙ্গে আরো একজন ছিল বলে মনে হয়েছে। আমরা আরো একটু শান্ত থাকতে পারলে তাকে ধরা হয়তো সম্ভব হতো।’

No comments

Powered by Blogger.