মোদি আসলে কার পক্ষে? by মাহফুজার রহমান

ফিলিস্তিন সংকট। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলমান অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর একটি। বলা যায়, ইসরায়েলি দখলদারি আর যুক্তরাষ্ট্রের একচোখা নীতির কারণে জিইয়ে রয়েছে এই সংকট। এমন দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যে দেশ দখলদার ইসরায়েল ও নিপীড়িত ফিলিস্তিন—দুই পক্ষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে ব্যস্ত। আপাতদৃষ্টিতে যেন সেই কাজই করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কারও পক্ষে বিবদমান দুই গোষ্ঠীরই প্রকৃত বন্ধু হওয়া কি সম্ভব? গত সপ্তাহেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিলিস্তিন সফর করেন মোদি। এই সফরে তিনি রামাল্লায় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। মোদিকে ‘মহান অতিথি’ হিসেবে অভিহিত করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ভারতের সমর্থন চান আব্বাস। মোদিও ঘোষণা দেন, নয়াদিল্লি খুব শিগগির স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দেখতে চায়। তিনি টুইট করেন, ‘ভারত-ফিলিস্তিনের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা খাতে ভারত-ফিলিস্তিনের পারস্পরিক যে সহযোগিতা চলছে, তাতে আমি আনন্দিত।’ এই মোদিই সাত মাস আগে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফর করেন। সেখানে দেওয়া ভাষণে মোদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বন্ধু সম্বোধন করেন। বলেন, ‘বন্ধুত্ব শুধু আমাদের দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মোদি-নেতানিয়াহুরও রয়েছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।’ এর ধারাবাহিকতায় গত মাসে ভারত সফর করেন নেতানিয়াহু। তিনি ভারতকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ বলে অভিহিত করেন। প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, জ্বালানি, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা হয় ‘দুই বন্ধুর’।
১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েল। ওই বছরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডসহ বেশ কিছু আরবভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রায় পুরোটাই ও মিসরে সিনাইয়ের কিছু ভূমিও দখল করে ইসরায়েল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সীমানা বরাদ্দ রেখেছিল, বর্তমানে তার অর্ধেকও ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে তাদের জমির ওপর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ইহুদি বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রায় ৭০ বছরে ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছে। মোদির ভারত কীভাবে একই সঙ্গে এই নিপীড়িত ফিলিস্তিন আর দখলদার ইসরায়েলের বন্ধু হবে? ইতিহাস বলে, ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। সেই ১৯৫১ সালেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক ছিল না ইসরায়েলের। তবে গত প্রায় ২৫ বছরে ভারত-ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর মোদি সরকারের সময় এই সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। কারও কারও মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে মোদির ভারতের বন্ধনের বিষয়টি আসলে ‘স্বাভাবিক’। কারণ, মোদির দল বিজেপি যেমন মুসলিমবিরোধী, ইসরায়েলও তা-ই। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যই মোদি-নেতানিয়াহুকে এত কাছাকাছি এনেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভবিষ্যতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নামা ভারতের চাই আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ নানা খাতে এগিয়ে যাওয়া। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) চলতি বছরের রিপোর্ট বলছে, এই মুহূর্তে সামরিক খাতে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছে ভারত। এ খাতে দেশটির বরাদ্দ পাঁচ হাজার কোটি ডলারের ওপরে। সুতরাং সামরিক বা প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বাইরের কারও কাছে যেতে হতো। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলই তাদের সবচেয়ে ভালো মিত্র। এই ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতার পর ফিলিস্তিনের দিকে ঘেঁষছেন কেন মোদি? এ বিষয়টাও স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সমর্থন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোতে বিভিন্ন খাতে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক কাজ করছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় পায় নয়াদিল্লি। জ্বালানি তেলের জন্যও ভারতের ভরসা মধ্যপ্রাচ্য। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ফিলিস্তিন সফরের পাশাপাশি জর্ডান, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। আর মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তি ইরানের সঙ্গে আলাদা করে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত মোদি সরকার। গত বৃহস্পতিবার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়ে নয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।
১০ বছরের মধ্যে কোনো ইরানি প্রেসিডেন্টের এটাই প্রথম ভারত সফর। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বাড়ানোর বিকল্প কৌশল নেই মোদির। মোদির আগেও ভারতের বিভিন্ন সরকারের আমলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্যোগ ছিল নয়াদিল্লির। আরব বিশ্বের বাইরে ভারতই প্রথম দেশ, যে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া গত ডিসেম্বরেও জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দেখা গেছে ভারতকে। পবিত্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব অনুমোদন হয়। ওই প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ১২৮ সদস্য ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। যার একটি ছিল ভারত। ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পর ভারত ফিলিস্তিনকেও গুরুত্ব দিচ্ছে—এর আরেকটি কারণ হলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে ভারতের। এটা পেতে হলে জাতিসংঘের সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন দরকার। এই সমর্থন পেতে নয়াদিল্লিকেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে হবে। এটাও প্রমাণ করতে হবে—আন্তর্জাতিক আইন-রীতির, শৃঙ্খলা, মানবিকতার প্রতি নয়াদিল্লির অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। সেই দিক বিবেচনায় ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিতেই হবে মোদির। মোট কথা, ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের যতই মধুর সম্পর্ক হোক না কেন, ফিলিস্তিনকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই নয়াদিল্লির। এ কারণেই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফর করা মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিলিস্তিন সফর করলেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনও ঘোষণা করলেন।
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
manik.mahfuz@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.