বাংলাদেশে জ্বালানি সহযোগিতায় রাশিয়া

স্বল্পোন্নত দেশ হলেও বাংলাদেশ দ্রুত স্থিতিশীল ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির একি দেশে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক দেশই এখন লাভজনক বিনিয়োগে আগ্রহী। দ্রুত বাজার সম্প্রসারণ ও সস্তা শ্রমের কারণে ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের মনোযোগ কেড়েছে এ দেশ। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে রাশিয়া দেশটির সাথে সম্পর্ক ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে। জ্বালানির মতো কৌশলগত বিনিয়োগে দেশটিতে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়া প্রধান উদ্যোগী বাংলাদেশে। বাংলাদেশে তেল ও বিদ্যুৎ সঙ্কট প্রধান সমস্যা। তেল, গ্যাস ও কয়লার মজুদ দেশে থাকলেও এ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। ২০০০ সাল থেকে দেশটিতে তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন ব্যাপকভাবে হয়নি। ২০১০ সালে সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে রাশিয়ার সহযোগিতা নিতে শুরু করে। পেট্রোবাংলার সাথে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সমঝোতা চুক্তি হয়। রাশিয়ায় যে মডেল অনুসরণ করা হয়, বাংলাদেশে তেল গ্যাস খাতে একই মডেল অনুসারে গ্যাজপ্রম আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রস্তাব করে। ২০১২ সালে বাপেক্স, বিজিএফসিএল ও এসজিএফএল’র সাথে গ্যাজপ্রম-এর চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত খনন কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের বসন্তে ও ২০১৪ সালের শীতে এ ধরনের ১০টি কূপ খনন করা হয়েছে। ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় রাশিয়ার সাথে এ ধরনের প্রকল্প উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের শরতে গ্যাজপ্রম আরো পাঁচটি কূপ খননের চুক্তি করেছে। ২০১৬ সালের মধ্যে এসব চুক্তি করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। গত বছর মার্চে বাপেক্সের সাথে গ্যাজপ্রম ভোলায় আরো দুইটি কূপ খননের চুক্তি করেছে। গত ডিসেম্বরে ‘গ্যাজপ্রম নর্থ ভোলা-১’ কূপে ৩.৫৫ কিলোমিটার গভীরে খননের সময় উচ্চ চাপ এড়াতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এটা বাংলাদেশের নেতাদের সঠিক সিদ্ধান্তের পরিচয় বহন করে। গত বছর বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের গড় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দিনে ৭০ মিলিয়ন ও বছরে ২৭ বিলিয়ন ঘনমিটার। এর ১০ শতাংশ গ্যাস এসেছে গ্যাজপ্রমের খননকৃত কূপ থেকে। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা বছরে ৩০ বিলিয়ন ঘনমিটার। তবে যে হারে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান চলছে তাতে এ চাহিদা কয়েক বছরের মধ্যেই পূরণ সম্ভব হবে। গ্যাসক্ষেত্রে উন্নয়ন নিয়ে যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সক্রিয় চিন্তা করছেন বাংলাদেশের নেতারা তা হলে গ্যাজপ্রম অন্তত এক শ’ নতুন কূপ খননের সুযোগ পাবে। একই সাথে বাপেক্স ও গ্যাজপ্রম যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের আলোচনা করছে। এর পাশাপাশি জালানি বিশেষজ্ঞ তৈরি করার জন্য রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশী ছাত্রদের পড়ালেখা এবং বাংলাদেশে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। এ কেন্দ্রে দেশটির বিশেষজ্ঞরা প্রশিক্ষণ দেবেন। ২০১১ সালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়া বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করেছে। রাশিয়ার ‘রোসাটম’ সংস্থার কোম্পানি ‘অ্যাটমস্ট্রোয়িএক্সপোর্ট’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৫ সালে রোসাটমের প্রধান সের্গেই কিরিয়েনকো বাংলাদেশ সফর করেছেন। রূপপুরে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি খরচ হবে। এর মধ্যে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়া ঋণ হিসাবে দেয় ২০১৬ সালে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সাথে ২০১১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তির পর ওই বছরের মার্চে জাপানের ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয় ঘটে যায়। এরপর অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ বা বাতিল করে দেয়। ফলে বাংলাদেশে যাতে কোনো বিপর্যয় না ঘটতে পারে সেজন্য রূপপুর প্রকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন রুশ পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। সেখানে ব্যবহার করা হবে ডব্লিউডব্লিউইআর মডেলের পারমাণবিক চুল্লি। বাংলাদেশে প্রতি বছর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার আশঙ্কা থাকে বলে এ ধরনের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ধারাবাহিক প্রকল্পের মাধ্যমে তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে রাশিয়া তার শক্তিশালী অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে। অন্যান্য খাতেও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দু’টি দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পরিমাণ ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধি পাচ্ছে সামরিক সহযোগিতাও। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দু’টি দেশের মধ্যে গভীর আস্থার সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে, চীন ও ভারত এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার উপস্থিতি আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে।
লেখক: রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, নিউ ইস্টার্ন
আউটলুকে নিয়মিত লিখে থাকেন।
ভাষান্তর- রাশিদুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.