পিংপংয়ের পর আণবিক কূটনীতি by আলমগীর মহিউদ্দিন

অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবতা হলো, বিশ্বের প্রধান ঘটনাবলির সূত্রপাত হয় ছোট্ট ঘটনা থেকে। অনুসন্ধানকারীরা এমন ছয়টি ঘটনার সন্ধান পেয়েছেন, যা আজকের আধুনিক বিশ্বকে নির্ মাণ করেছে। যেমন ০১. একটি স্যান্ডউইচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী। ০২. একটি আর্ট স্কুলের ভর্তি সমস্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পেছনে। ০৩. একটি সিগারেটের বাক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করে। ০৪. ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের আদান-প্রদান সৃষ্টি করে এক সাম্রাজ্য। ০৫. একটি ‘হার্ট অ্যাটাক’ বাঁচিয়ে দেয় পশ্চিমা জগৎকে।
০৬. এক উল্কাবৃষ্টি সাহায্য করে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করতে। গ্যাব্রিলো প্রিনসিপ ছিল সার্বিয়ার স্বাধীনতাকামী গোপন দল ‘ব্লাক হ্যান্ড’-এর সদস্য। তাদের লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করে সার্বিয়াকে স্বাধীন করা। অস্ট্রিয়া তখন সার্বিয়া দখল করে রেখেছিল। তাই ব্লাক হ্যান্ড ফার্ডিনান্ডের গাড়িবহরের ওপর বোমা হামলা চালায়। সে হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে দলের সদস্যরা এক রেস্টুরেন্টে সমবেত হয় বিষয়টি আলোচনার জন্য। বোমাটা ছুড়েছিল প্রিনসিপ এবং সে ছিল সরব। হঠাৎ লক্ষ করল, তাদের রেস্টুরেন্টের পাশের রাস্তা দিয়ে ফার্ডিনান্ডের গাড়িবহরটি যাচ্ছে এবং ফার্ডিনান্ড খোলা জানালার পাশে বসা। প্রিনসিপ সময়ক্ষেপণ না করে তার রিভলবারটা দিয়ে গুলিবর্ষণ করে এবং ফার্ডিনান্ড মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এর ফল হয় ভয়াবহ। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো এবং মৃত্যুবরণ করল কোটি কোটি মানুষ। ধ্বংস হলো বিশাল। ভিয়েনার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য এলো এক যুবক। দু’বার চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারল না। তার চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন মুছে গেল। সে থাকত ভিয়েনার এক বস্তিতে। সেখানে চেক, ক্রোশিয়ান, ইতালিয়ান ও কয়েকজন ইহুদি থাকত। তারা সবাই বেকার ও নিম্নশ্রেণীর। এর মাঝে ইহুদিরা ওই যুবককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করল। তখন সে আর্মিতে যোগদান করে। তাকে মিলিটারি পুলিশে পোস্টিং দেয়া হলো। যোগ্যতার বলে সে দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাকে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিতে (নাজি পার্টি) যোগদান করে তাদের সব তথ্য গোপনে সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হলো। এ যুবক আর কেউ নন, বিশ্বখ্যাত অ্যাডলফ হিটলার। নাজি পার্টি ‘ভার্সাই চুক্তি’কে দাসত্ব মনে করত এবং তা বানচালের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বরাজনৈতিক চিত্রের আমূল পরিবর্তন। যদি প্রিনসিপ স্যান্ডউইচ না খেতে যেত এবং হিটলার যদি আর্ট স্কুলে ভর্তি হতো, তাহলে ইতিহাস নিশ্চয়ই অন্য রকম হতো। এমন ছোট ঘটনা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বারবার। যেমন- রাস্তায় পড়ে থাকা একটি সিগারেটের বাক্স মার্কিন গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায় এবং দেশটির দু’টি ভাগে বিভক্ত হওয়া ঠেকিয়ে দেয়। যখন উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে যুক্তরাষ্ট্র ভাগ হওয়া প্রায় নিশ্চিত, তখনই ছোট্ট ঘটনাটি ঘটল। কর্পোরাল বার্টন ডাবলু মিশেল লক্ষ করেন, রাস্তায় এক সিগারেটের বাক্স এবং তিনটি সিগারেট এর বাইরে। তিনি বাক্সটা উঠিয়ে দেখেন তার মাঝে অনেক কাগজ। কাগজগুলো আর কিছুই নয়। সুপ্রিম কমান্ডার রবার্ট লি’র ১৯১ হুকুমনামা। এ হুকুমনামায় কেমনভাবে যুদ্ধ করতে হবে তিনি তার বিশদ নির্দেশনা দেন এবং তার সব জেনারেলের কাছে পাঠান। এর মধ্যে একজন ছিলেন স্টোনওয়াল জ্যাকসন। তিনি ছিলেন অলস প্রকৃতির জেনারেল। তিনি হুকুমনামাগুলো অনুসরণ করে নতুন হুকুমনামা না লিখে লির পাঠানো কাগজগুলোই কমান্ডারদের কাছে পাঠালেন। তার মতোই অলস ছিল এক কমান্ডার- ড্যানিয়েল হার্ভে হিল। তিনি তার ক্যাম্পসাইটে হুকুমনামাগুলো ফেলে রেখেছিলেন, যা রাস্তায় গিয়ে পৌঁছে। মিশেল সেখানেই এটা পান। তখন এটা কমান্ডারদের পৌঁছে দেয়া হলে, তারা সেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং দেশটিও অখণ্ড থেকে যায়। জন্মগতভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফরাসি ছিলেন না। কারণ তার জন্ম হয়েছিল কর্সিকা দ্বীপে, যা ছিল ইতালির অংশ বা তুর্কির অংশ। জেনোয়ার ডিউক এটা ফরাসিদের কাছে বিক্রি করে দেন। তখন নেপোলিয়ন ফরাসি নাগরিকত্ব পেলেন এবং সেই সূত্রে তিনি ফরাসি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। এর পরের ঘটনাগুলো ঘটল দ্রুত। নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সর্বময় ক্ষমতা দখল করলেন।পশ্চিমা বিশ্ব আজ যে অবস্থানে তা হয়তো অসম্ভব হতো, যদি ‘তার’ হার্ট অ্যাটাক না হতো। চেঙ্গিস খান মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দ্রুত ইউরোপের দিকে এগোচ্ছিলেন এবং তখন এটা সবাই ধরে নিয়েছিল ইউরোপ চেঙ্গিস খানের কব্জায় পড়ে যাবে। ইউরোপিয়ানরা চেঙ্গিসকে সাদর আহ্বান  জানাচ্ছিল এ জন্য যে, তারা মুসলিম অধীনতা ছিন্ন করতে চাইছিল। চেঙ্গিস মুসলমানদের তখন পরাজিত করেছিলেন। তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন এবং তার ছেলে ওজেদি খানকে মঙ্গোলিয়া ফিরে যেতে হলো। ইউরোপ বেঁচে গেল মুসলিম সাম্রাজ্যের মতো ধ্বংস ও দখলের হাত থেকে। তবে এ যুদ্ধে বিশ্বে যোগাযোগের পথ খুলে যাওয়ায় ইউরোপ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে যায়।আকাশজুড়ে তখন উল্কাপাত হচ্ছিল। খানিকটা অস্বাভাবিক। একজন সহযোগী কনস্টানটাইনকে বলল, দেখুন, উল্কার আলোর মাঝে লেখা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে- ‘এই ক্রস দিয়ে জয় করো।’
কনস্টানটাইন তখন রোমের সিংহাসনের জন্য আরেক দাবিদার মাক্সেনটাইনের সাথে যুদ্ধ করছিলেন। এ লেখা কনস্টানটাইনের জন্য বলে কথাটি ছড়িয়ে দেয়া হলো এবং বলা হলো ‘গড তোমার সাথে’। সে অনুসারে কনস্টানটাইন যুদ্ধ শুরু করলেন। তিনি যুদ্ধে জিতে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন এবং খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেন এবং হুকুম জারি করেন রোমান সাম্রাজ্যে শুধু খ্রিষ্টানরাই বাস করবে। তার এই হুকুমের পথ ধরে পরবর্তী ধর্মান্তকরণের কর্মকাণ্ডে এখন বিশ্বের প্রথম ধর্ম বিশ্বাস হলো খ্রিষ্টান ধর্ম। এই ধারা ধরে রাখার সব চেষ্টা ও ব্যবস্থা চলছে অবিরাম। ছোট্ট ঘটনা থেকে এই ছয়টি বিশাল ঘটনা ঘটেছে বলে অনুসন্ধানকারীরা এই কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরেন। তাদের বক্তব্য, অনেক সময় দেখা যায়- বিশাল আয়োজন ও পরিকল্পনার ফল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশানুরূপ হয় না। তখন সবার মাঝে একটা হতাশা এবং এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনীহা দেখা দেয়। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক অনুসন্ধান পরিচালনা করেছে। তারা জানতে চায় ছোট্ট খবর বা ঘটনা সমাজের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে কি না। কাজটি ছিল কঠিন। কেননা কোনো খবরের কাগজ যেমন ছোট্ট ঘটনার প্রতিবেদন দেয়, তেমনি বড় ঘটনার প্রতিবেদনও সেই সাথে থাকে। তারা তাই ছোট ছোট খবরের কাগজ ও সংবাদ সংস্থা বেছে নেয় এবং যখন সাধারণত বড় খবর থাকে না বলে বলা হয়, সে সময়টা বেছে নেয়। এমন দশটি মিডিয়াতে ৩৫ বার এই পরীক্ষা চালানো হয়। মিডিয়া কনসোর্টিয়াম এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর জো এলেন গ্রিন কাইজার বলেন, ‘অনুসন্ধানকারীরা দেখতে পান এমনকি ছোট্ট সংবাদমাধ্যম এবং নিরপেক্ষ বলে পরিচিত খবরের কাগজগুলোর সংবাদ জাতীয় ঘটনাবলির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।’ তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি সুবিধা হলো, তাদের কোনো অদৃশ্য বা দৃশ্যমান কর্তৃপক্ষের কথা শুনতে হয় না। ফলে আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এমনভাবে বাড়ছে। কাইজার লিখছেন, এ জন্য বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাবানেরা সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ চাইছে। তারা এটা পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ। এ জন্যই তারা চায় পুলিশ স্টেট এবং পুলিশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। তারা জনকল্যাণ বা জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবে না। কারণ, পুলিশের জন্মই হয়েছিল এলিটদের রক্ষার জন্য, যে কার্যক্রমে কখনো ছেদ পড়েনি। ছোট্ট ঘটনার মধ্যে পিংপংয়ের খেলা নিয়ে যে কূটনীতি তা বর্তমান বিশ্বের জন্ম দেয় বললে অত্যুক্তি হবে না। ছেচল্লিশ বছর আগে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিল। তখন চীনের এক টেবিলটেনিস দল ডেট্রয়টে মার্কিনিদের সাথে পিংপং খেলতে আসে। এটা ছিল ‘পিংপং কূটনীতি’র প্রথম পদক্ষেপ। এটা শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে। জাপানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব টেবিলটেনিস টুর্নামেন্টে যখন মার্কিন দল খেলতে যায়, তখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চীন তাদের দেশে যাওয়ার জন্য মার্কিন দলকে আমন্ত্রণ জানায়। চীন তাদের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চাইছিল। মার্কিন দলের চীনে যাওয়ার পর চীন-মার্কিন সংযোগ বাড়তে থাকে এবং তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সন এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে গোপনে তার সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারকে বেইজিং পাঠান। এরপর তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেইজিং যান। পিংপং কূটনীতির এক ব্যাপক সাফল্য বলে একে অভিহিত করা হয়। এর ফলে কয়েক যুগের ঠাণ্ডা যুদ্ধ (কোল্ড ওয়ার) বলে পরিচিত এক অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটে। এবার বিশ্ব আবার এক ভীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে দু’টি কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং উত্তর কোরিয়ার আণবিক বোমার পরীক্ষা। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বারবার ঘোষণা যে, তারা উত্তর কোরিয়াকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন এবং তার জবাবে উত্তর কোরিয়ার বক্তব্য, তাদের আণবিক বোমা বহনকারী মিসাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সহজেই পৌঁছতে পারে- সারা বিশ্বকে এখন নিদারুণ শঙ্কার মাঝে রেখেছে। অবশ্য ১৯৮৬ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া এই আণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝে উত্তর কোরিয়া তার আণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে বিষয়টি জটিল হয় ও শঙ্কার পর্যায়ে চলে যায়। তবে একটি নতুন পরিস্থিতি হলো, চীন ও উত্তর কোরিয়ার শীতল সম্পর্ক। এই ত্রিমুখী অবস্থার কী পরিণতি হবে বলা মুশকিল। কারণ, উত্তর কোরিয়াকে কেউ আস্থায় নিতে পারছে না; যেমন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে উত্তর কোরিয়ার আলোচনার প্রস্তাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের ওপর চাপ সেই ভীতিকর তৃতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনার দাবিকে অযৌক্তিক প্রমাণ করতে পারে। কেবল সময়ই বলতে পারবে এর জবাব। তবে সবাই আশা করে, পিংপং কূটনীতির যেমন জয় হয়ে বিশ্বরাজনীতিতে এক মোড় নিয়েছিল, এবার এই আণবিক কূটনীতির সাফল্যে বিশ্ব বেঁচে যাবে। কারণ, সবার মাঝেই একটি উপলব্ধি কাজ করে যে, যুদ্ধে আণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বকে ধ্বংস করবে, নতুনভাবে সৃষ্টি করবে না। অতীতের ধ্বংসতাণ্ডব এর কাছে অত্যন্ত নগণ্য বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.