মেয়রের পরিচয় সেবক নগরপিতা নয়



মেয়র একজন জনপ্রতিনিধি। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য মেয়র পদে নির্বাচিত হন। পৌরসভা ও সিটি ক র্পোরেশন উভয়ের নির্বাচিত প্রধানকে মেয়র বলা হয়। অতীতে পৌরসভার প্রধান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান নামে অভিহিত হতেন। বর্তমানে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন উভয়ের প্রধান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মেয়র নামে অভিহিত হন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের কিছু গণমাধ্যম ও সাংবাদিক অযাচিতভাবে কোনো ধরনের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি ব্যতিরেকেই দীর্ঘদিন ধরে ‘নগরপিতা’ নামে অভিহিত করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন থাকলেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের ক্ষেত্রেই নগরপিতা শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। মেয়রের ন্যায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কাউন্সিলরাও নির্ধারিত এলাকার বিপরীতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। কোনো কাউন্সিলরকে কখনোই তিনি যে এলাকা থেকে নির্বাচিত, সে এলাকার নামানুসারে ‘পিতা’ নামে অভিহিত করা হয় না। অনুরূপ পৌরসভার চেয়ারম্যানদেরও পৌরসভার নাম উল্লেখপূর্বক পিতা নামে অভিহিত করা হয় না। আমাদের দেশে দু’ধরনের জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর একটি হল, একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং অপরটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীন বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত যথাক্রমে মেয়র ও কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়র ও কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড মেম্বার (সাধারণ সদস্য)। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলার অন্তর্ভুক্ত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হন। উভয় ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্ধারিত পদমর্যাদা রয়েছে। তাছাড়া তারা সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে নির্ধারিত বেতন, ভাতা, সম্মানী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদি প্রাপ্ত হন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের নগরপিতা নামে অভিহিত করা হলে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীন নির্বাচিত সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত যথাক্রমে মেয়র ও কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়র ও কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড মেম্বাররা স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকার পিতা হওয়ার সমঅধিকারী। সমগ্র মানবজাতির পিতা হচ্ছেন হজরত আদম (আ.)। আর মুসলিম জাতির পিতা হলেন হজরত ইব্রাহীম (আ.)। প্রতিটি ব্যক্তির জন্মদাতা পিতা একজন। কিছু কিছু রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বিশেষ ব্যক্তির অবদান থাকায় তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশে স্ব স্ব দেশের নির্ধারিত আইনের অধীনে তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের জাতির পিতার মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হয়েছে। আবার এমন রাষ্ট্রও রয়েছে, যেখানে একাধিক ব্যক্তিকে জাতির পিতার পরিবর্তে জাতি বা রাষ্ট্রের স্থপতিরূপে সম্মানিত করা হয়েছে। জন্মদাতা পিতার অবস্থান সব সময় স্থায়ী। অনুরূপ মানবজাতির পিতা ও মুসলিম জাতির পিতার অবস্থানও স্থায়ী। সচরাচর জাতির পিতা বা জাতির স্থপতির অবস্থান স্থায়ী হয়ে থাকে।
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে বা রাষ্ট্র দ্বিখণ্ডিত হলে জাতির পিতার পরিবর্তন লক্ষণীয়। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের ন্যায় অপরাপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। যে কোনো নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়ে যিনি বিজয়ী হন, তাকেই একটি পদের বিপরীতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এরূপ জনপ্রতিনিধির পদে বহাল থাকার বিষয়টি আইন দ্বারা নির্ধারিত। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদের মেয়াদের অবসান ঘটলে তিনি আর জনপ্রতিনিধি নন। পিতা শব্দটি ব্যক্তি সংশ্লেষে স্থায়ী হলেও সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের ক্ষেত্রে স্থায়ী নয়। একজন ব্যক্তি নির্বাচনে পরাভূত হলে তাকে সিটি কর্পোরেশনভুক্ত নগরের পিতা নামে অভিহিত করার অবকাশ থাকে না। সব ধরনের জনপ্রতিনিধিই জনগণের সেবক। নিজ নিজ এলাকার জনমানুষকে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার মানসে একজন ব্যক্তি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে সফলতা পেলে তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত হন। আমাদের দেশে বর্তমানে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোয় নারীদের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষিত থাকলেও তাদের জন্য পুরুষের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম বিধিনিষেধ নেই।জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে অনেক নারী বিজয়ী হচ্ছেন। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও একাধিকবার জনৈক নারী প্রার্থীকে বিজয়ী হতে দেখা গেছে, যিনি বর্তমানেও মেয়র পদে আসীন আছেন। স্বভাবতই প্রশ্নের উদয় হয়, সিটি কর্পোরেশনের পুরুষ মেয়রকে নগরপিতা নামে অভিহিত করা হলে কোনো সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচিত নারী মেয়র কি নামে অভিহিত হবেন? স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এ লাভজনক পদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুরূপ। কিন্তু স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ, ২০০৮-এর লাভজনক পদের ব্যাখ্যায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এখানে বলা হয়েছে, ‘লাভজনক’ পদ অর্থ প্রজাতন্ত্র কিংবা সরকারি সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ কিংবা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে বেতন, সম্মানী কিংবা আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত লাভজনক পদ বা অবস্থান। স্পষ্টত শেষোক্ত ব্যাখ্যায় বেতন ব্যতিরেকে সম্মানী বা আর্থিক অথবা অন্য কোনোভাবে সুবিধা প্রাপ্তিকে লাভজনক বলা হয়েছে। যদিও সাধারণ অর্থে প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ বলতে এমন সব পদধারীকে বোঝায়, যারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা ও সম্মানী গ্রহণ করে থাকেন। এ অর্থে গণকর্মচারীরা (Public Servant) প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত মর্মে গণ্য। উল্লেখ্য, আমাদের সংসদ সদস্যরা ভ্রমণভাতা, আবাসন সুবিধা, করমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ প্রভৃতি ছাড়াও প্রতি মাসে অন্যান্য যেসব বেতন-ভাতা ও সম্মানী পেয়ে থাকেন, তার পরিমাণ লক্ষাধিক টাকা। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলে ঘোষিত হতে পারে, এরূপ অন্য কোনো কর্ম। অপরদিকে ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত ব্যক্তি। সংবিধানে উল্লিখিত সরকারি কর্মচারীকে ইংরেজিতে বলা হয়েছে Public Officer. সংবিধানে উল্লিখিত Public Officer এবং দণ্ডবিধির ২১নং ধারায় উল্লিখিত Public Servant একটি অপরটির সমার্থক কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত Public Servant ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। দণ্ডবিধিতে অপরাধ হিসেবে উল্লিখিত উৎকোচ গ্রহণ, অসাধুভাবে সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য একজন সরকারি কর্মচারীর ন্যায় স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের অপরাধ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭, ফৌজদারি সংশোধন আইন, ১৯৫৮ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-সহ দণ্ডবিধির অধীন শাস্তিযোগ্য হওয়ায় স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের Public Servant অর্থাৎ গণকর্মচারী-বহির্ভূত বিবেচনার অবকাশ আছে কিনা, সে প্রশ্নটি এসে যায়। সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের যেমন কর্তব্য, অনুরূপ সব সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। জনপ্রতিনিধিরা গণকর্মচারী গণ্যে জনগণকে সেবা প্রদান তাদের আবশ্যিক কর্তব্য। এ বিষয়টিকে আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার যে কোনো মূলনীতি মেনে চলার বিষয়ে দেশের প্রতিটি নাগরিকের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অধীন পরিচালিত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হলে প্রকৃত অর্থেই সৎ, যোগ্য, ত্যাগী ও জনদরদি ব্যক্তি নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন। নির্বাচন কলুষিত ও ত্রুটিপূর্ণ হলে এর ব্যত্যয় ঘটে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এবং সভ্য সমাজে কলুষিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশিত না হলেও অনেক তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাষ্ট্র এ কালিমায় আচ্ছন্ন। জন্মদাতা পিতা সচরাচর তার সব সন্তানকে সমদৃষ্টিতে দেখে থাকেন এবং সমভাবে আদর-স্নেহের মাধ্যমে লালন-পালন করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রয়াস নেন। একজন পিতার এ প্রয়াসে কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ও স্বার্থের লেশ থাকে না। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের একজন মেয়র বা অপর যে কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেসব ভোটার তার বিরোধী প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন করেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সমভাবে দেখেন না। এটি যে কোনো প্রকৃত পিতার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। একজন ভোটার কখনও ভোট দিয়ে পিতা বানায় না। ভোটার যাকে ভোট দেন, তিনি তার প্রতিনিধি বা সেবক। প্রতিনিধি বা সেবক পৃথিবীর কোথাও পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, এমনটি আমাদের দেশ ব্যতীত অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে যেসব গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মী জনপ্রতিনিধি বা সেবক হিসেবে নির্বাচিত সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নগরপিতা আখ্যা দিয়ে তাদের বিশেষভাবে সম্মানিত করার প্রয়াসে লিপ্ত, তারা নিছক ভ্রান্ত ধারণা বা আবেগের বশবর্তী হয়ে এ কাজটি করে সাধারণ মানুষকে ভুল বার্তা দিয়ে চলেছেন।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান ও রাজনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.