হুমকির মুখে গণতন্ত্র

আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল-উদ্যোক্তা ও নেটস্পেস প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যান্ড্রিসন ২০১১ সালে ‘হোয়াই সফটওয়্যার ইজ ইটিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখেন, যা বহুলপঠিত হয়। কিন্তু আমরা তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে নিইনি। আমরা সেটাকে কেবল রূপক ভেবেছিলাম। অথচ এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো পৃথিবীকে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের একচেটিয়াত্ব থেকে মুক্ত করা। প্রযুক্তি বিষয়ে আমি একজন আশাবাদী ছিলাম। ৩৫ বছরের ক্যারিয়ারে আমি নিজের সেরা ও উজ্জ্বল সময়টা সিলিকন ভ্যালিতে দিয়েছি। আমার সৌভাগ্য, ব্যক্তিগত কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অংশ হতে পেরেছি আমি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আমার উল্লেখযোগ্য কাজ হলো গুগল ও আমাজনে বিনিয়োগ করা। এ ছাড়া ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমি ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের পরামর্শদাতা ছিলাম।
প্রযুক্তির প্রতিটি নতুন ঢেউয়ের সঙ্গে উৎপাদনশীলতা যেমন বেড়েছে, তেমনি জ্ঞানের ভান্ডারে আমাদের প্রবেশের সুযোগও বেড়েছে। প্রতিটি নতুন প্ল্যাটফর্ম আগের প্ল্যাটফর্মের চেয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য ও সুবিধাজনক। বছরের পর বছর ধরে এটি পৃথিবীকে আরও উন্নত করেছে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এটা তা-ই করবে। এরপর এল ২০১৬ সাল, যে বার আমরা ইন্টারনেটের দুটি অন্ধকার অধ্যায় দেখতে পেলাম। একটি দিক ব্যবহারকারী সম্পর্কিত। এলটিই অবকাঠামোযুক্ত স্মার্টফোন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কনটেন্ট ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যেটা পুরো জাগ্রত মুহূর্তে ব্যবহারের উপযোগী ছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি শিল্প ও ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর জীবন বদলে গেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গায় তেমন একটা তত্ত্বাবধান না থাকায় ফেসবুক, আলিবাবা, গুগল, আমাজন, টেনসেন্ট প্রচারণা ও জুয়ার কৌশল ব্যবহার করে গ্রাহকদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ তৈরি করেছে। আরেকটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক হলো ভূরাজনৈতিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ ও এশিয়ায় ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্যে ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতাহীনদের নিপীড়ন করার সুযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে, স্বয়ংক্রিয় সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে খাটো করা সম্ভব। এর আগে ব্রেক্সিট গণভোট ও মার্কিন নির্বাচনের সময়ও আমরা দেখেছি, ইতিবাচক খবরের তুলনায় নেতিবাচক খবর ফেসবুকে বেশি প্রচারণা পায়। কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো নিপীড়নমূলক নীতির সপক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারে; মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনে এখন যা ঘটছে, কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক অন্য সব বড় গ্রাহকের মতো প্রকৃত অর্থে এসব সরকারকে সমর্থন দেয়। আমি আত্মবিশ্বাসী যে ব্যবসায়িক মডেল গ্রহণের সময় ফেসবুক, গুগল ও অন্যান্য ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম মানুষের ক্ষতি করতে চায়নি। এরা তখন তরুণ উদ্যোক্তা, সফলতার জন্য বুভুক্ষু। তারা একগুচ্ছ অ্যাপ্লিকেশনের ভিত্তিতে অনলাইনের জগৎ পুনর্গঠন করেছে। যার কারণে এটি আগের চেয়ে আরও বেশি ব্যক্তিগত প্ল্যাটফর্ম ও ব্যবহারের দিক থেকে সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে। ব্যবহারকারীরা এতে অভ্যস্ত হওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত তাঁরা এটা থেকে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবেননি। উদ্যোক্তারা সামাজিক মাধ্যমকে যে আরও বেশি ব্যক্তিগত করে গড়ে তুলেছেন, তার ভিত্তিতেই এঁরা বিজ্ঞাপনী ব্যবসার মডেল তৈরি করেছেন। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা অভূতপূর্ব নির্ভুলতার সঙ্গে তাদের বার্তা উদ্দিষ্ট শ্রেণির কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। এরপর এল স্মার্টফোন, যার মাধ্যমে সব গণমাধ্যমের রূপ বদলে গেল। এর বদৌলতে ফেসবুক, গুগল ও গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল। যে ছাঁকনি মানুষকে ‘চাহিদামতো’ সেবা দিতে পারে, সে মানুষকে বিভক্ত করতে পারে। এতে মুক্ত গণমাধ্যমের মতো মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ক্ষয়ে যেতে পারে। যে স্বতশ্চলনের (অটোমেশন) কারণে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম এত লাভজনক হয়েছে, সে কারণেই ইন্টারনেটের হানিকর মানুষের কারসাজিতে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
গণতন্ত্র বৈরী কর্তৃত্ববাদী সরকারই যে শুধু এই উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করছে, তা নয়। অ্যান্ড্রিসন আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উপস্থিতি নিয়ে এই কোম্পানিগুলো বিশ্ব অর্থনীতি খেয়ে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা ফেসবুকের করপোরেট দর্শন গ্রহণ করেছে: ‘দ্রুত চলো ও সব ভেঙে ফেলো’। তাতে মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও গণতন্ত্রের ওপর কী প্রভাব পড়ল, সেটা বিচার্য বিষয় নয়। উন্নত বিশ্বের এক বড় সংখ্যালঘু শ্রেণি এসব প্রতিষ্ঠানসৃষ্ট এই ছাঁকন বুদ্বুদের মধ্যে বসবাস করে, যেখানে বিদ্যমান বিশ্বাসগুলো আরও কট্টর ও অনমনীয় হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নতুন চিন্তা গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়ছেন, এমনকি তথ্য-প্রমাণ থাকলেও। এই মানুষদের সহজেই প্রভাবিত করা যায়। গুগলের সাবেক ডিজাইন নীতিবিদ ত্রিস্তান হ্যারিস এই ধারণার উদ্গাতা, যাকে বলা হয় ‘ব্রেইন হ্যাকিং’। ব্যাপারটা হলো, পশ্চিমা গণতন্ত্র এই হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কার্যকর আইনি কাঠামো নেই, তাদের সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছাও নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেমন আইনি কাঠামো আছে, তেমনি তার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছাও আছে। কিন্তু কোনোটিই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। তারা যে সম্প্রতি প্রতিযোগিতাবিরোধী আচরণের জন্য গুগলকে ২৭০ কোটি ডলার জরিমানা করেছে, তা যথেষ্ট চিন্তাপ্রসূত হলেও আকারে ছোট হয়ে গেছে। গুগল আপিল করেছে। আর তার বিনিয়োগকারীরা এসব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। শুরু হিসেবে হয়তো এটা ভালো, কিন্তু তা পরিষ্কারভাবে অনুপযুক্ত। আমরা এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত হয়েছি। ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মজাত ঝুঁকির ব্যাপারটা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেই আসছে। কিন্তু এটা ব্যবহার এত সহজ এবং তার প্রতি মানুষের যে মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যবহারকারীর দিক থেকে পরিবর্তন আসতে গেলে আরও অনেক সময় লাগবে, অন্তত কয়েকটা প্রজন্ম; ধূমপানবিরোধী প্রচারণার সফলতা পেতে যেমনটা লেগেছে। প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের ওপর এই ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপ বেশি সচেতন। কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত কার্যকর আইনি কাঠামো নির্মাণ করতে পারেনি। এটা ব্যবহার করে যে গণতন্ত্র খাটো করা যায়, সে ব্যাপারে সচেতনতা ক্রমেই বাড়ছে। তবে পশ্চিমা শক্তিগুলো এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত প্রতিরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি। সদ্য সমাপ্ত দাভোসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম মনোপলির হুমকি সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত। জীবনে ভারসাম্য ও রাজনীতিতে আশার পুনর্জীবন ঘটাতে হলে যারা আমাদের জীবনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তাদের কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
রজার ম্যাকনামি: এলিভেশন পার্টনারের সহপ্রতিষ্ঠাতা।

No comments

Powered by Blogger.