যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধ’ ঘোষণা

২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি দিনটি ওয়াশিংটনের একটি নতুন ঠাণ্ডা বা স্নায়ুযুদ্ধের ঘোষণা দেয়ার তারিখ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জন হপকিন্স ভার্সিটিতে ভাষণ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস এ ঘোষণা দিলেন। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির নতুন করে অবনমনই প্রকট হয়ে উঠেছে। মি. ম্যাটিসের এই বক্তৃতা নিশ্চিত করেছে, ট্রাম্প প্রশাসন আগের চেয়ে বেশি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্গঠিত করবে বলে যে ধারণা বা প্রত্যাশা থাকতে পারে, তা প্রবাদের ডোডো পাখির মতোই মৃত (মরিশাসের এই বিরাট পাখি উড়তে পারত না এবং বর্তমানে বিলুপ্ত)। বরং এই অবস্থায়, যেসব দেশ ‘সাম্রাজ্যের নির্দেশ’ পালনে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তাদের পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিকল্প নেই। এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিন্ন ক্ষোভ রয়েছে। রিচার্ড সাকওয়া তার 'Frontline Ukraine' বইতে এই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীলদের (নিউকন) শেকড় যে ট্রটস্কিপন্থীদের মাঝে প্রোথিত, তা অনেকেরই জানা আছে। তাদের বিশ্বাস : ‘বিশ্ববিপ্লব’ বাতিল হয়ে যায়নি, এর কেবল রূপান্তর ঘটেছে। তারা মনে করেন এখন লড়াই সমাজতন্ত্র নয়, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের জন্য। এটা হবে বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ বানানোর উদ্দেশ্যে। ‘নিউকন’ হিসেবে যিনি লজ্জিত নন, সেই টমাস ফ্রিডম্যান একই কথা আরো স্পষ্টভাবে বলেছেন। এ ব্যাপারে তার কুখ্যাত জোরালো বক্তব্য হলো- “বাজার অর্থনীতির লুকানো হাত সক্রিয় রাখতে লুকানো মুষ্টি থাকতে হয়। ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ সমৃদ্ধ হতে পারে না ‘ম্যাকডোনেল ডগলাস’ ছাড়া। এই ডগলাস হলেন এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের নির্মাতা। সিলিকন ভ্যালির যাবতীয় প্রযুক্তির জন্য দুনিয়াকে নিরাপদ রাখছে যে ‘লুকায়িত মুষ্টি’, তার নাম মার্কিন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী এবং মেরিন কোর।” রুশ মিডিয়া পাশ্চাত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো এবং পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাহস দেখিয়েছে। এই মিডিয়া সামগ্রিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আসছে। তার আসল কারণ এটাই। আরটি এবং স্পুটনিক সাফল্যের সাথে একটি সাম্রাজ্যের ভণ্ডামি, দ্বিমুখী নীতি ও অসততা উন্মোচন করে দিয়েছে। এই সাম্রাজ্যটি গণতন্ত্রের পোশাক পরে স্বীয় আধিপত্যের দণ্ডবিকশিত করা পশুটিকে বিশেষ পরিচ্ছদে শোভিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আফ্রিকার একটি প্রবাদ হলো, ‘সিংহের যত দিন না নিজস্ব ইতিহাসবিদ থাকে, তত দিন শিকারের কাহিনীগুলো সর্বদাই শিকারির জন্য গৌরবজনক হিসেবে গণ্য হবে।’ বিকল্প মিডিয়া থাকায় আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি যেখানে সিংহদের নিজস্ব ‘ইতিহাসবিদ’ আছে। যেসব দেশ ও সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রোধের পাত্র, তারা একধরনের সিংহ বটে।
তাদের ইতিহাসবিশারদরা সাফল্যের সাথে এবং ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তুলে ধরছেন যে, ‘পশ্চিমা আদর্শের প্রবক্তারা দেশে দেশে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে গণতন্ত্রের অজুহাত দেখালেও গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। অথচ জাতিসঙ্ঘ সনদ মোতাবেক, এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রই আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি।’ যা হোক, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ম্যাটিস তার ভাষণে রাশিয়া ও চীনকে ‘সংশোধনবাদী শক্তি’ বলার মতো হঠকারিতা দেখিয়েছেন। এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটির নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি। এই রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী দীর্ঘ দিন ধরে দাবি করছে, দুনিয়াজুড়ে শাসনের অধিকার তারা রাখেন। রাশিয়া অল্প সময়ের জন্য পাশ্চাত্যের আদর্শিক চশমা পরিধান করেছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়াশিংটনের অধীনতামূলক অবস্থান নিতে রাশিয়া রাজি হয়নি। তখনই তার আসল অপরাধের সূচনা। তাকে নতজানু করার মতলবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ‘শক ট্রিটমেন্ট’ দেয়ার প্রয়াস সফলভাবে সে প্রতিহত করেছে। ইরাকের জনগণকে জিজ্ঞেস করুন শান্তি বজায় রাখায় মার্কিন সেনাদের ভূমিকা সম্পর্কে। লিবিয়ার মানুষের খবর কী? ওয়াশিংটন সিরিয়ায় দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ও নৈরাজ্য দীর্ঘায়িত করার প্রয়াসে সফল হয়েছে। সে ব্যাপারে সিরীয় জনগণকে প্রশ্ন করে দেখুন। আর আফগানিস্তান তো আছেই। সে দেশে গত এক দশকেরও বেশি সময়ে মার্কিন ও ন্যাটোর বোমায় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শান্তি রক্ষার কথা বলতে চান? টেনিস কিংবদন্তি জন ম্যাকেনরোর অননুকরণীয় কথাটির পুনরাবৃত্তি করছি- ম্যাটিস সাহেব, আপনারা শান্তি রক্ষার প্রশ্নে ‘সিরিয়াস হতে পারবেন না।’ যে পর্যন্ত না তারা সিরিয়াস হবেন, তত দিন রোমান সাম্রাজ্যের অনুসরণে জেমস ম্যাটিস বলবেন- Pax Americana, মানে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ‘শান্তি’ চাপিয়ে দেবে। আসলে এটা আধিপত্য ও দাসত্ব। এহেন কথিত শান্তির মূল কথাটা রোমের ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস সবচেয়ে জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছেন, “ডাকাতরা দুনিয়ার ভূ-উপরিস্থ সব লুটে নেয়ার পালা শেষ করে এরপর গভীরে অনুসন্ধান করে আরো লুণ্ঠনের লক্ষ্যে। ওদের শত্রু যদি ধনী হয়, ওরা শত্রুর ধনসম্পদের জন্য লোভী হয়ে ওঠে। আর শত্রু গরিব হলে লোভটা গিয়ে পড়ে শত্রুর ভূখণ্ডের ওপর। দুনিয়ার প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, কোনোটাই তাদের খুশি করতে পারেনি। ধনী-গরিব কাউকে ওরা রেহাই দেয় না। ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠনকে তারা ‘সাম্রাজ্য’ নাম দিয়ে মিথ্যাচার চালায়। তেমনি তারা কোনো ভূখণ্ডকে মরুভূমি বানিয়ে তাকে বলে ‘শান্তি’।” জেমস ম্যাটিস এবং তার সমগোত্রীয়দের বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত ইতিহাসের দিকে। কারণ, ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো- সাম্রাজ্যের ভিত্তি বালুর তৈরি এবং যারা মানুষের ওপর আধিপত্য করতে চায়, তারা নিজেদের পতন ত্বরান্বিত করে।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম

No comments

Powered by Blogger.