দিনাজপুরের শিশুটির কথা মনে আছে? by মানসুরা হোসাইন

মেয়েটি সাত বছরে পা দিয়েছে। স্কুলে ভর্তি হলেও যেতে পারছে না। যাবে কীভাবে? ওর তো সব সময় প্রস্রাব ঝরে। অন্য বাচ্চাদের সামনে যেতে লজ্জা পায়। খেলতে খেলতে মাঝেমধ্যেই আনমনা হয়ে যায়। কোনো কিছু হয়তো চিন্তা করে। চিন্তা তো করতেই পারে। মাত্র পাঁচ পার হওয়া বয়সেই মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তার প্রজনন অঙ্গ, মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকার ক্ষত ছিল।
মেয়েটি কি এত সহজে সবকিছু ভুলতে পারবে? বলছিলাম দিনাজপুরের শিশুটির কথা। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর শিশুটি নিখোঁজ হয়। পরদিন শিশুটিকে তার বাড়ির কাছে এক খেতের মধ্যে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার প্রজনন অঙ্গে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর বাড়ি ফিরতে পারলেও ঢাকা মেডিকেলে হাজির হতে হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। মেয়েটির বাবা টেলিফোনে জানালেন, মেয়ে এখন একা একা হাঁটতে পারে। তবে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর কয়েক দিন পরেই মেয়েকে নিয়ে আবার ঢাকায় আসবেন। কয়েক দিন ধরেই মেয়েটির কথা মনে হচ্ছে। ও যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ছিল, তখন গেলেই মায়াভরা চোখে হাসত। মুঠোফোনে ছবি তুললে তা দেখতে চাইত। একধরনের সখ্য গড়ে উঠলেও মেয়েটির সামনে গেলে ওর বাবা ও নানির সামনে কোনো কথা বলতে পারতাম না। কিছুক্ষণ পাশে বসে মাথা নিচু করে চলে আসতে হতো। সময় পার হচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি কি পাল্টেছে? ২২ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনের খবর অনুযায়ী, চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনিতে পরিবারের সঙ্গে থাকত নয় বছরের ফাতেমা আক্তার। পড়ত স্থানীয় একটি মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ২১ জানুয়ারি বিকেলে খেলতে বাসা থেকে বের হয় সে। এরপর আর ফেরেনি শিশুটি। ছয় ঘণ্টা পর এলাকার আরেক ভবনের সিঁড়িতে পাওয়া যায় তার লাশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, শিশুটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষককে চিনে ফেলায় হয়তো শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি শিশুদের নিয়ে কাজ করা ২৬৯টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম শিশু অধিকার পরিস্থিতি-২০১৭ প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যা ২০১৬ সালের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। গত বছর ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে ৭০ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। ৪৪ প্রতিবন্ধী শিশুও এ ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যায়নি। ২২ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, ৭ শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করে। সব মিলে বছরটিতে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৯৪, যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি ছিল।
এ প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালে এ ধরনের ঘটনা ২০১৫ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছিল। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনা আবার বাড়ছে। গত বছর পর্নোগ্রাফির শিকার হয় ২৬ শিশু, যা আগের বছরের তুলনায় ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মাত্র ৩২টি শিশু ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে, যার বেশির ভাগই ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল বা তারও আগের ঘটনা ছিল। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন, সংবাদকর্মী বা বেশির ভাগ মানুষের কাছে হয়তো এগুলো সংখ্যা ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু দিনাজপুরের ওই মা-বাবা বা চট্টগ্রামের শিশুর অভিভাবকদের কাছে কি এগুলো শুধু সংখ্যা? এই সংখ্যাগুলো সমাজ বা রাষ্ট্রকে অস্বস্তিতে ফেলছে না? কিন্তু অস্বস্তিতে ফেলছে তাও তো বলার উপায় নেই। কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে? একটি করে ঘটনা ঘটে, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক গরম হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ অন্যরা হাসপাতালে গিয়ে ঘটা করে ওই শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন বা কিছু আর্থিক সাহায্য দেন। মামলা চলতে থাকে মামলার গতিতে। তারপর ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার ছাড়া আর কারও সে কথা মনে থাকে না। আবার ঘটনা ঘটলে তখন সবার হুঁশ হয়। কয়েক দিন ধরে সবার মনোযোগ কেড়েছে সাত বা আট বছরের শিশু জয়নাব আনসারি। নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর একটি আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ছোট্ট জয়নাবের লাশ। শিশুটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় উত্তাল পাকিস্তান। ‘জাস্টিস ফর জয়নাব’ স্লোগান দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানাতে পাকিস্তানের এক টেলিভিশন উপস্থাপিকা কিরণ নাজ নিজের ছোট্ট মেয়েকে কোলে বসিয়ে খবর পড়েছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মেয়েকে কোলে নিয়ে খবর পড়তে বসে কিরণ বলেন, ‘আজ আমি আপনাদের সামনে সঞ্চালক নই, একজন মা হিসেবে এসেছি। আর তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি মেয়েকে। পাকিস্তান আজ প্রচণ্ড ভারী এক কফিন বইছে।’ ঘটনার পর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের কাসুরে বিক্ষোভের প্রথম দিনে পুলিশ গুলি চালালে জনতাদের মধ্যে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। পুলিশ বলছে, কাসুরে গত দুই বছরে এ রকম ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জয়নাব হত্যার ঘটনা ব্যাপক সাড়া ফেলে। ‘হ্যাশট্যাগ জাস্টিস ফর জয়নাব’ লিখে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও ক্রিকেট তারকারা। তাঁরা হত্যাকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছেন। ৪ জানুয়ারি বাড়ির পাশে থেকে নিখোঁজ হয় জয়নাব। ৯ জানুয়ারি একটি আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। জয়নাবকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ১০ জানুয়ারি যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।
তারা ৩০০টি মোবাইল ফোনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। পুলিশ প্রায় ১ হাজার ৩০০ লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। দুজন সন্দেহভাজনকে আটকও করেছে পুলিশ। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে সেদেশের সরকার যৌথ তদন্ত দল গঠন করে দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি কাসুর এলাকায় একইরকম আরো সাতটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তও চালাবার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই জয়নাবের কোনো না কোনা আপডেট থাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়া তা প্রচার ও প্রকাশ করছে। কিন্তু আমাদেরই দিনাজপুরের শিশুটির কথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। এরপর তালিকায় যোগ হয়েছে আরও কত শিশু। জয়নাবের জন্য পাকিস্তানের কিছু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন, আমরা তাও করিনি। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, তাদের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। আমরা দিনাজপুরের শিশুসহ বিভিন্ন শিশুর খবর সংগ্রহ করি, লিখি। তারপর বাসায় ফিরে নিজেদের মেয়েদের বুকের মধ্যে নিয়ে জড়িয়ে থাকি। অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে বুক। কয়েক দিন ধরেই ভাবছি, এ অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হবে না? রাষ্ট্র চাইলে কি যথাযথ তদন্ত করে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে পারে না? দিনাজপুরের শিশুটির বাবা জানালেন, ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পার্বতীপুর থানায় মামলা করেছিলেন। মামলার দুই আসামির মধ্যে একজন কারাগারে, আরেকজন জামিনে আছেন। মামলা চলছে মামলার গতিতে। মেয়েটি তো চলতে পারছে না!
মানসুরা হোসাইন: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.