শিল্প-সংস্কৃতিতে গতি সঞ্চার করেছে আমাদের বিজয়

দেশ সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়। স্বাধীনতার পর উন্নতি, উন্নয়ন ইত্যাদির মূল্যায়নে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি নিয়ে। দৈনিক যুগান্তরের পক্ষ থেকে তেমনটির সম্মুখীন আমাদেরও হতে হল। উত্তরটি মৌখিক না হয়ে লিখিত দেয়ার অনুরোধও করা হয়েছে। তো, এসব নিয়ে বলার মতো জ্ঞান-গরিমা আমার প্রায় শূন্যের কোঠায়। বলা যায়, খালি চোখে দেখার বাইরে গভীর হিসাব-নিকাশ তেমন করিনি কখনও। তবে অবস্থাদৃষ্টে বলতেই হয়, শিল্পকলা বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেশকিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। যেমন- ভালো হোক বা মন্দ, গ্রহণযোগ্য হোক বা সমালোচিত, দেশে প্রচুর ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এ নিয়ে ভাস্করদের ব্যস্ততা বেড়েছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এটি শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার একটি ভালো লক্ষণ। আধুনিক চিত্রকলা দিকটিতে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের চর্চা বেগবান হয়েছে গত কয়েক বছরে। তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে এবং প্রশংসা প্রাপ্তি ঘটেছে। বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সৃজনশীল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এসবের প্রধান কারণটি হল শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে বৈরী দিনকালের সম্মুখীন হতে হয়নি গত কয়েক বছর। দেশে শিল্পকলার সংগ্রাহক এখন অনেকাংশে বেড়ে গেছে। গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক। সেগুলোতে প্রচুর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দর্শক সমাগমও সন্তোষজনক। লোকশিল্পের বেলায়ও একই কথা খাটে। জামদানিসহ বেশকিছু দিকে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বেড়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের নকশি শীতল পাটি। ইউনেস্কো বিশেষ ঐতিহ্যিক বিষয় হিসেবে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি দিয়েছে। যেমন একইভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইনট্রানজিবল হেরিটেজ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখী বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাটি। এসব গুরুত্ববাহী অর্জনের এবং প্রাপ্তির দরজাগুলো খুলতে পারা গেছে বর্তমান সরকারের আমলে, পৃষ্ঠপোষকতায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নাট্যকলা, নৃত্য, সৃজনশীল চলচ্চিত্র ইত্যাদির চর্চা বেড়েছে। মোটকথা সুরুচির দিকগুলো নিয়ে চমৎকার একটি আবহ বিরাজমান সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে কয়েক বছর ধরে বিশাল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর বসছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এসব আয়োজন আমাদের অর্জন। সুরুচি বিস্তরণের এসব দিক আমাদের প্রাপ্তির অংশ।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কাজ করার যে স্পৃহা এবং চর্চার বেগবান গতি পাওয়ার কারণ আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা এবং একটি নিজস্ব ভূখণ্ড। বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ জনগণের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে প্রোজ্জ্বলিত করেছিল। সেই ভাষণকে শিরোধার্য করে বাঙালির নিজস্ব বাসভূমি হিসেবে এ স্বাধীন দেশটি অর্জিত হয়েছিল। একাত্তরের ৭ মার্চের সেই অসাধারণ উদ্বুদ্ধকারী ভাষণ বিশ্বের সেরা ঘটনার স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কোর আয়োজনে। এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের সব প্রজন্মের জনগণকে দেশাত্মবোধে চিরকাল উজ্জীবিত রাখবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভূত। গর্বিত বোধ করছি ভেবে যে, সেই ভাষণ শোনার কোটি মানুষের ঢলে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা পাথেয় হয়ে আছে আজও। শিল্পকলার ক্ষেত্রে এসব প্রাপ্তি চোখে পড়ার মতো। তবে অতৃপ্তিও আছে চারুশিল্পীদের। তা হল রং-তুলি, কাগজ-ক্যানভাসের অগ্নিমূল্য। বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসব মেটেরিয়াল বা সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি আমদানি করে থাকেন। দেশে কোনো কারখানা নেই। অতএব, পরমুখাপেক্ষী থাকাই নিয়ম। নির্ভরতাও তাদের ওপর। কিন্তু বেঁধে দেয়া অগ্নিমূল্যের কারণে শিল্পীদের চর্চা অনেকটাই ব্যাহত হয়। তার পরও থমকে যায়নি শিল্পীদের কর্মকাণ্ড। বিশ্বমানের শিল্প সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা আমাদের গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করছেন। এটা অনেক বড় পাওয়া।

No comments

Powered by Blogger.