রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৩৭২ শাখা লোকসানে

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং যত্রতত্র শাখা খোলার কারণে বাড়ছে লোকসানি শাখা। বিশেষ করে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক দুটিতে লোকসানি শাখা ছিল ২৬১টি। চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২৭৯টিতে। এতে পাঁচ মাসে দুই ব্যাংকের লোকসানি শাখা বেড়েছে ১৮টি। এছাড়া বিডিবিএলের লোকসানি শাখা আগের ১৯টিতে অবস্থান করছে। তবে গত জুনে কিছুটা কমে রূপালী ব্যাংকের লোকসানি শাখার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪টিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি লোকসানি শাখা একীভূত (মার্জ) করার চিন্তাভাবনা চলছে। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় স্থানে গড়ে ওঠা লোকসানি শাখাগুলো অন্যত্র স্থানান্তর এবং সব লোকসানি শাখা মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকে বর্তমানে লোকসানি শাখা রয়েছে ২৫০টি; যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২৩৩টি। সে হিসাবে পাঁচ মাসে লোকসানি শাখা বেড়েছে ১৭টি। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে আড়াইশ’ শাখা লোকসানে আছে। এগুলো কমানোর জন্য সব লোকসানি শাখার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। একইসঙ্গে জোরদার করা হবে মনিটরিং। সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুনে রূপালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা দাঁড়ায় ৭৪টিতে; যা গত বছরের জুনে ছিল ১৩৯টি। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, লোকসানি শাখা আরও কমিয়ে আনা হবে। প্রয়োজনে বেশকিছু শাখা একীভূত করা হবে। কিছু শাখা স্থানান্তর করা হবে।
সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের লোকসানি শাখা ২৯টি; যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ২৮টি। এছাড়া বিডিবিএলের লোকসানি শাখা ১৯টি; যা অপরিবর্তিত। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিচালকরা নিজেদের স্বার্থে বেশকিছু শাখা খুলেছেন। যার অধিকাংশ এখন লোকসানি শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল ও রূপালী ব্যাংকে এ ধরনের প্রায় ২৪টি শাখা খোলার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া সরকারি অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, বিডিবিএলের পরিচালকদের নেয়া বেশিরভাগ শাখা-ই লোকসানে। শুধু তাই নয়, কয়েকটি শাখায় ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। একদিকে নিজের শাখা, অন্যদিকে নিজস্ব লোকজন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের কোনো কোনো শাখায় অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিডিবিএল পরিচালকদের নেয়া শাখার সংখ্যা ৮টি। এর মধ্যে বি.বাড়িয়ায় ‘আশুগঞ্জ শাখা’ খুলেছেন সাবেক পরিচালক ইসহাক ভূঁইয়া। তিনিই প্রথম উপজেলা পর্যায়ে শাখা খোলার প্রচলন করেন। শাখাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিয়মে ঠাসা। যে ভবনে শাখা অফিস আবার সে ভবনেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। সংশ্লিষ্ট পরিচালকের যোগসাজশে শাখা অফিসের ভাড়া অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবে অনেক ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একইভাবে বিডিবিএলের সাবেক পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম দুটি শাখা খুলেছেন। একটি নিজের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। অপরটি শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জের মহাদেবপুর। বিডিবিএলের বর্তমান পরিচালক সৈয়দ এপতার হোসেন পিয়ার সিলেটে খুলেছেন ‘ওসমানী নগর শাখা’। বিভিন্ন সময় অনিয়মের কারণে শাখাটি লোকসানে পড়েছে। সাবেক পরিচালক রুস্তম আলী নীলফামারীতে খুলেছেন ‘কাজিরহাট শাখা’। বগুড়ায় ‘মোকামতলা শাখা’ খুলেছেন ব্যাংকের সাবেক এমডি। উভয় শাখা বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে লোকসানে পড়েছে। বি.বাড়িয়ায় নবীনগর শাখা খুলেছেন সাবেক পরিচালক কাজী মোর্শেদ হোসেন কামাল। খেলাপি ঋণের ভারে এটিও লোকসানে। একই কারণে লোকসানে পড়েছে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর শাখা। শাখাটি খুলেছেন বিডিবিএলের সাবেক পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান হুমায়ূন। এছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের পরিচালকরা ১৬টি শাখা খুলেছেন। এসব শাখার অধিকাংশ লোকসানে। এর মধ্যে শুধু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও এমডি-ই ভাগাভাগি করে ১৫টি শাখা খুলেছেন। বাকি ১টি শাখা খুলেছেন ব্যাংকের অপর পরিচালক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমদ আল কবির গত কয়েক বছরে নিজের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট এলাকায় ৮টি শাখা খুলেছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সিলেটের জকিগঞ্জে নিজ বাড়ির দরজায় কালিগঞ্জ শাখাটি খোলা হয়েছে। একইভাবে মৌলভীবাজার সদরে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি খোলা হয়েছে গোবিন্দপুর শাখা। বাবুবাজার শাখাটি খোলা হয়েছে মৌলভীবাজারের জকিগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। জঙ্গলের মধ্যে গড়ে ওঠা শাখাটি কখনও লাভে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জকিগঞ্জে একটি শাখা রয়েছে। তার ওপর আরও একটি শাখা পাহাড়ের মধ্যে গড়ে তোলার দরকার ছিল না। শাখাটি সাবেক চেয়ারম্যানের স্বার্থে খোলা হয়েছে; যা কোনো দিন লাভের মুখ দেখবে না। একইভাবে রাজাগঞ্জ শাখা ও কানাইঘাট শাখা খোলা হয়েছে সিলেটের কানাইঘাটে। পাশাপাশি দুটি শাখার দরকার ছিল না বলে মনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শ্বশুরবাড়ির পাশে আরও একটি শাখা খোলা হয়েছে। এটি হল কুলাউড়া শাখা। এছাড়া মদিনা মার্কেট শাখা খোলা হয়েছে সিলেটের জালালাবাদে। এর বাইরে দেলিয়াই বাজার শাখা উদ্বোধন করেন রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমদ আল কবির। সবক’টি শাখা-ই লোকসানি ছিল। তবে বর্তমান ম্যানেজমেন্ট তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। রূপালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ব্যারিস্টার জাকির আহমেদ নিজের কলেজের সামনে শাখা খুলেছেন। বি.বাড়িয়ায় নিজের বাড়ির দরজায় খোলা শাখার এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি চায়ের দোকানও নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। নির্জন এলাকায় গড়ে ওঠা শাখাটির লোকসানের ঘানি টানছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিনের নিজের বাড়ি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট এলাকায় খোলা হয়েছে আরও ৭টি শাখা। এগুলো হল কাওরিয়া বাজার শাখা, মুলাদী বন্দর শাখা, মঠবাড়িয়া শাখা, মেহেন্দিগঞ্জ শাখা, ভাণ্ডারিয়া শাখা, পুটিয়াখালি বন্দর শাখা ও ইলিশা জংশন শাখা। এর একটি শাখাও লাভের মুখ দেখেনি। তবে এখন কিছু শাখা তা কাটিয়ে উঠছে।

No comments

Powered by Blogger.