বঙ্গবন্ধু আছেন চেতনায় হৃদয়ে

একটা সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াই নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের ক্ষমতার দাপটে বাঙালি জাতি কুঁকড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম বলা যায় না, তাকে নিয়ে লেখা যায় না। লেখলেই নির্যাতনের ভয়। এ অবস্থায়ও কেউ কেউ লেখলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প লেখলেন আবুল ফজল, কবিতা লেখলেন নির্মলেন্দু গুণ। আমিও একটা গল্প লেখলাম। ’৭৮ সালের কথা। গল্পের নাম ‘মানুষ কাঁদছে’। বঙ্গবন্ধুর জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে কান্না উৎসারিত হয় এক যুবকের। বাঙালি হয়েও বঙ্গবন্ধুকে সে বাঁচাতে পারেনি- এরকম এক অপরাধবোধের গল্প। সেই যুবক নিজেকে কাপুরুষ মনে করে। তার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ বঙ্গবন্ধু। লৌহজং মাঠে একবার সে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিল। আরেকবার দেখেছিল ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু খোলা জিপে করে যাচ্ছেন। দু’বারই বঙ্গবন্ধুকে দেখে সে বলেছিল, বঙ্গবন্ধু, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসত। দিনমজুর ভাগচাষী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ। সাধারণ মানুষের অসাধারণ নেতা ছিলেন তিনি। বাঙালির নয়নের মণি ছিলেন। পঁচাত্তরের সেই বীভৎস ভোরে যখন জানা গেল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দরিদ্র রান্নাঘরে সকালের নাশতা তৈরি করছিলেন মা। যখন শুনলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, দিশেহারার মতো সব ফেলে ছুটে বেরুলেন। হায় হায় কয় কী! বঙ্গবন্ধুরে মাইরা ফালাইছে? কোন শয়তানরা করল এই কাজ? আমার মা তারপর কাঁদতে লাগলেন। অঝোরধারায় কান্না। পিতার মৃত্যুতে যেমন করে কাঁদে মানুষ, ঠিক সেরকম কান্না। আমরা পাথর হয়ে রইলাম। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সেদিন এরকম নিঃশব্দে কেঁদেছে লাখ-কোটি মানুষ। প্রিয় নেতাকে, জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে যে খুনিরা, তাদের অভিশাপ দিয়েছে। তারপর কত কত দিন কেটে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেয়া হয়নি। বাঙালিকে লেখতে দেয়া হয়নি তাদের জাতির জনকের কথা। কিন্তু প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালি চেয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। ফাঁসিতে ঝোলানো হোক খুনিদের। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার বিচার করেছেন। বাঙালির বুক থেকে নামিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে চেপে বসা পাথর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেও জাতির দায়মুক্তি করেছেন তিনি। পঁচাত্তরের সেই দিনটির কথা আমার খুব মনে পড়ে। এত বেদনার দিন বাঙালির জীবনে আর কখনও আসেনি। বঙ্গবন্ধুর শোকে সেদিন নিঃস্তব্ধ হয়েছিল দেশের মানুষ, বইতে ভুলে গিয়েছিল আগস্ট মাসের হাওয়া, গান বন্ধ করেছিল পাখিরা, থেমে গিয়েছিল নদীর সে াতধারা, সূর্যের তলায় এসে দাঁড়িয়েছিল ঘন কালো মেঘ। আমাদের চারিদিক ডুবে গিয়েছিল গভীর অন্ধকারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কি আসলে হত্যা করা যায়? শারীরিকভাবে তিনি নেই, তার আদর্শ রয়ে গেছে আমাদের চেতনায়। তিনি হচ্ছেন বাঙালির জাতির আকাশ। আকাশ সব সময় মাথার উপরে থাকে। তিনি আছেন আমাদের মাথার উপর। তার দেখানো পথ আর আদর্শ আমাদের চালিত করছে। তার দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তারপরও বঙ্গবন্ধুর জন্য বাঙালি জাতি চিরকাল কাঁদবে।

No comments

Powered by Blogger.