ঈর্ষা নেই, যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাই সব

কেউ বা কোনো গোষ্ঠী যদি ভালো থাকে, সুখে থাকে, সরকারের কাছ থেকে আরও অনেক সুবিধা আদায় করে স্বর্গসুখ রচনা করে, তাতে আমি কখনও ঈর্ষাবোধ করি না। ঈর্ষা মনে না পোষার শিক্ষা ছেলেবেলা থেকে পরিবারের কাছেই পেয়েছি। তাই ৩ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় যখন শিরোনাম দেখলাম ‘সব সুবিধা চান সচিবরা- বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী’ তখন একটু চমকে গিয়েছিলাম। রিপোর্টটি পড়ার পর আর চমক থাকেনি। আমি সচিবদের প্রতি সহমর্মিতাই প্রকাশ করেছি। এর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্বার্থও রয়েছে। আমি সব সময় কামনা করি আমার বন্ধুরা ভালো থাকুন। আর এখন পাঁচজন সচিব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আরও দু-তিনজন হয়তো সহসাই সচিব হবেন। আমি জানি ওরা দেশের জন্য, সরকার পরিচালনার জন্য কতটা সময় দেন, মেধা খরচ করেন। আমি সাধারণত ব্যস্ত মানুষকে অযথা বিরক্ত করি না। যেহেতু আমি তদবির করা পছন্দ করি না এবং আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে কেউ কোনো ব্যাপারে কোনো কিছুর জন্য তদবির করলেও আমি বিরক্তবোধ করি, তাই সচিব বন্ধুদের কাছে আমার ফোন করার দরকারও কম পড়ে। তবুও আমরা সামাজিক জীব। মাঝেমধ্যে অনুরোধ আসে। যে বিষয়গুলো খুব মানবিক, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না অথচ অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, তেমন ক্ষেত্রে কোনো বন্ধুকে ফোন করি। ওরা যথেষ্ট বন্ধুবৎসল। বুঝতে পারি কত ব্যস্ত থাকেন। বেশিক্ষণ কথা বলতে নিজেরই দ্বিধা লাগে। ও প্রান্ত থেকে জানতে পারি ব্যস্ততার খতিয়ান। একের পর এক মিটিং। বিদেশ সফরের তাড়াহুড়ো। বঙ্গভবন বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে হবে এক্ষুনি বা অমুক প্রজেক্ট পরিদর্শনের জন্য গাড়ি প্রস্তুত। অর্থাৎ সরকারের প্রশাসন পরিচালনার জন্য রাত-দিন শ্রম ও মেধা দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের সচিবরা। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রেরও উচিত তাদের এ ঋণ সামান্য হলেও পরিশোধ করা। আমরা শিক্ষকরা আদার বেপারি।
অনেকে জাহাজের খবর রাখি না। এ রিপোর্ট থেকে জানলাম সচিবরা অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকার সময় গাড়ি, বাড়ি, গৃহকর্মীসহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। এ তথ্যে আমি খুব খুশি। কারণ আমি মনে করি, এটুকু সুবিধা না দিলে অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে চিহ্নিত হতে হতো আমাদের। যারা দেশের প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজে রাত-দিন পরিশ্রম করেন, এটুকু সুবিধা তো তাদের প্রাপ্য। কখনও কখনও কোনো পাপীষ্ঠ বন্ধু আমাদের কল্পলোকের সুখ নষ্ট করতে চায় কুমন্ত্রণা দিয়ে। বলে, ‘কী পেলে জীবনে! তোমার সচিব বন্ধুর চেয়ে অনেক ভালো ফল করেছ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি দায়িত্ব হিসেবে রাত-দিন গবেষণা করে যাচ্ছ। একের পর এক বই লিখছ, যা শিক্ষার্থী বা গবেষকদের উপকারে লাগছে। এ জন্য রাষ্ট্র তেমন প্রণোদনা দিচ্ছে না। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে গবেষণার ব্যয় নির্বাহ করছ। রাষ্ট্রীয় বেতন কাঠামোর এক নম্বর স্কেলে থেকে মহাস্বস্তিতে আছ। তোমার কোনো গাড়ি সুবিধা, আর্দালি চাপরাশি সুবিধা নেই। একজন সিনিয়র অধ্যাপক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে, না হলে ঢাকা-ধামরাইয়ের বাসে ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগর কর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাক বলে বেতনের ৫০ ভাগ বাড়িভাড়া ও নানা কর্তনের পর যৎসামান্যই হাতে পাও। তা দিয়ে হিসাব-নিকাশ করে সংসার চালাতে হয়। তা হলে কী লাভ হল তোমার শিক্ষক হয়ে!’ আমি এসব প্ররোচনায় কান দেই না। অযথা প্রলুব্ধ হই না। স্বস্তি পাই এই ভেবে, এখনও সমাজের অনেকের চেয়ে ভালো আছি। অন্তত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে পারবেন না, ‘বেতন-ভাতা বেড়েছে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে’। আমি তো স্বেচ্ছায় শিক্ষকতায় এসেছি। সব জেনেই এসেছি। মনে পড়ে এমএ পরীক্ষার পরপর এখন অবসরপ্রাপ্ত আমার ঘনিষ্ঠ আমলা আত্মীয় বিসিএস পরীক্ষার ফরম নিয়ে এসেছিলেন। তার খুব ইচ্ছে আমি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি। তার বিশ্বাস, আমি পরীক্ষায় বসলেই ভালো ক্যাডার পেয়ে যাব; কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই আমি শিক্ষক হওয়ার জন্য লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। আত্মীয় বোঝালেন একজন ক্যাডার কর্মকর্তা হলে অর্থে আর ক্ষমতার দাপটে বিশাল কেউকেটা হব। কিন্তু ওসব আমাকে প্রলুব্ধ করেনি।
তাই শিক্ষকতায় থাকার সময় বেতন-ভাতার বাইরে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার অভিজ্ঞতা যখন শিক্ষকদের থাকে না, তখন সচিবদের সব রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগ করা এবং পেনশনকালীন এ সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য দাবি জানানোতে আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রতিক্রিয়া থাকার কথা নয়। একটি বিষয়ে খুব তৃপ্তিবোধ করছি। সচিবরা ৬২ বছর পর্যন্ত চাকরিসীমা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। তুলনা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর আছে বলে মন্তব্য করেছেন। খুব ভালো লেগেছে এ কথাটি পত্রিকায় পড়ে। অন্তত একটি ক্ষেত্রে সচিবরা তাদের সঙ্গে এ প্রাকৃতজন শিক্ষকদের তুলনা করেছেন। আমি তো বলব, সচিবদের অবদান বিবেচনা করে রাষ্ট্রের মূল্যায়ন করা উচিত। দু-চারজন দুর্নীতি করেন বলে তো সবাইকে শাস্তি দেয়া যায় না। তবে সচেতন অনেকের ধারণা সময় বুঝেই সচিবরা দাবি উত্থাপন করেছেন। এসব দাবির অনেকটা অর্জিতও হবে। কারণ অদ্ভুত গণতন্ত্রে চলছি আমরা। মানুষ বিশ্বাস করে, নির্বাচনে জেতা না-জেতায় প্রশাসনের ভূমিকা এখন গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং তুরুপের তাস তো হাতে আছেই! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুর্নীতি করার সুযোগ তেমন নেই। তবুও মাঝেমধ্যে দু-চারজন শিক্ষকের কথা শোনা যেত। যারা ফাঁকিবাজ ধরনের। তারা শিক্ষক-ছাত্র সবার কাছে নিন্দিত হতেন এবং এখনও হন। এখন এ মাত্রা অনেক বেড়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য ধরনের নানা দুর্নীতির কথাও শোনা যাচ্ছে। তদন্ত করলে দেখা যাবে ধারার শিক্ষকদের অধিকাংশই কমিটেড শিক্ষক নন, কাম্য একাডেমিক যোগ্যতাও সবার নেই। নষ্ট রাজনীতি তাদের শিক্ষক বানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির জন্য নিবেদিত শিক্ষকদের সঙ্গে এদের তুলনা করা কখনও উচিত হবে না। আমাদের সচিবরা ৬২ বছর চাকরির সময়সীমা বাড়ানোর যুক্তিতে প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিয়েছেন। ভালো লাগত এ সঙ্গে অন্যদের স্বার্থ জুড়ে দিলে। ভারতে অনেক আগেই প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত সবাইকে যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছে রাষ্ট্র। আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো করেছে। দিয়েছে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। এ কারণে প্রাইমারি স্কুলেই মেধাবী পিএইচডি করা শিক্ষকও অনেক দেখা যায়। উচ্চ বেতন, সহজ শর্তে গাড়ি লোন, ফ্ল্যাট কেনার ঋণ এসব পেয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিশ্চিন্তে শিক্ষাদান ও গবেষণায় যুক্ত থাকছেন। আমি ১৯৯২-৯৩ সালে গবেষণার কাজে কলকাতায় ছিলাম। সে সময় সম্ভবত আনন্দবাজার পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেখানে লেখা হয়েছিল, ‘আমাদের ব্যুরোক্র্যাট, ব্যাংকার সবার ভিত্তি তো তৈরি করে দেন শিক্ষকরা। এ কারণে শিক্ষকের অবস্থান সবার ওপরে নিশ্চিত করতে হবে।’ আমাদের দেশের রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে এর এক বড় ফারাক আছে। আমাদের সমাজে কত অসঙ্গতি। স্বার্থপরতা কত বিস্তার লাভ করছে! যখন সচিব মহোদয়রা পিআরএলের পর এখন পেনশনকালীনও গাড়ি, বাড়ি, ভৃত্যসহ সব সুবিধা পেতে চাইছেন, তখনই ৪ জুনের একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট পড়ে থমকে যেতে হল। জানা গেল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ক্ষুব্ধ। কারণ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে তাদের এমপিওর অর্থ থেকে আগে ৬ শতাংশ হারে কেটে রাখা হতো; কিন্তু নতুন সিদ্ধান্তে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হবে। অথচ বাড়তি টাকা দেয়ার বিনিময়ে চাকরি শেষে তারা অতিরিক্ত কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না। প্রাসঙ্গিকভাবে আমার এক বন্ধু মনে করিয়ে দিলেন, এ শিক্ষকদের হাত ধরেই তো অনেকে সচিব হয়েছেন- হবেন। তার ভাষ্যমতে, সচিব মহোদয়দের গাড়ির জ্বালানি ভাতা বা বিভিন্ন মিটিংয়ের অ্যালাউন্সের খণ্ডিতাংশও তো এসব শিক্ষকের বেতন নয়। তারপরও শিক্ষকদের ওপর এ রাষ্ট্রীয় পীড়ন কেন? আমরা সচিব মহোদয়দের সব দাবি অর্জিত হোক এ শুভ কামনা করে বলব, সবকিছু নিয়েই একটি রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি। একেক গোষ্ঠীর দায়িত্ব পালনের ধারা একেক রকম। সবার সমন্বিত অবদানে একটি রাষ্ট্র উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। যার হাতে ক্ষমতা আছে, সে ক্ষমতার দাপটে সবাইকে মাড়িয়ে যাবেন তা হতে পারে না। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা প্রভু হতে পারেন না। জনগণের কাছেই শেষ পর্যন্ত সবার দায়বদ্ধতা থাকে। তবে একেক পরিবেশে একেক ধরনের মানুষ বেড়ে ওঠে। তাদের স্বভাবেও তাই ভিন্নতা থাকে। একজন ক্ষমতাবান সরকারি আমলার কাছে ঠাটবাট, গাড়ি-ড্রাইভার, আর্দালি-চাপরাশি তার আভরণ।
ওগুলোর মধ্য দিয়েই নিজের অবস্থানকে বোঝাতে চান। একজন নিবেদিত শিক্ষক তার আভরণ মনে করেন ক্লাসরুমে নিজ শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের আলো বিতরণ করা। গবেষণা করা, গ্রন্থ রচনা করা। শিক্ষক ভীতি প্রদর্শন করে শ্রদ্ধা আদায় করতে চান না। স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা পাওয়াতেই তার আনন্দ। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক কখনও দাবি করবেন না, ‘আমি সচিবের সমান স্কেলে বেতন পাই, আমাকে অন্তত গাড়ি সুবিধা দাও বা সহজ শর্তে গাড়ি কেনা বা ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দাও।’ ভাঙা বাসে গাদাগাদি করে যাওয়ায় একজন শিক্ষকের আপত্তি থাকে না। যিনি চাকরিকালীন মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেননি, তিনি অপেক্ষা করেন অবসরের জন্য। অবসরের পর যা পাবেন, তা দিয়ে একটি বাড়ি করার স্বপ্ন বোনেন। অমন স্বপ্ন দেখার আনন্দ নিয়েই দিন কাটে তার। আমাদের এখন সরকারের কাছে একটি অনুরোধ রাখার সময় এসে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য উন্নত দেশের মর্যাদায় পৌঁছে যাওয়া। লক্ষ্যপূরণের পথ কি খুবই সরল? এ পথে দৃঢ়তার সঙ্গে হাঁটতে হলে রাষ্ট্রীয় আদর্শ, নীতি ও লক্ষ্য স্থির করতে হবে। একই রাষ্ট্রীয় ও সরকার কাঠামোয় নানা রকম বৈষম্য বজায় থাকলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অসন্তোষের বাড়বাড়ন্ত হবে। এ অবস্থা চলার পথকে মসৃণ থাকতে দেবে না। এখন ব্রিটিশ শাসন যুগ বা পাকিস্তান পর্ব নেই যে, আমলাতন্ত্র সবার মাথায় একচ্ছত্রভাবে ছড়ি ঘোরাবে। মানুষ এখন অনেক সচেতন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার এ সত্যটি নিশ্চয়ই অনুধাবন করবে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.