ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ার যাতনা

রাজধানীতে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) হিসাব অনুযায়ী, গত মে থেকে জুলাইয়ের ৭ তারিখ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৫৬৬ জন আর চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৩ জন। তবে প্রকৃতপক্ষে শুধু রাজধানীতেই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
চিকুনগুনিয়ার আগমন
১৯৫২ সালে আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পরে তা সাতটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং নাইজেরিয়ার জনগণ এই ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে সবচে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। ২০০৫ সালে ভারতে, ২০০৭ সালে ইতালি, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের লোকজন চিকুনগুনিয়ার কষ্ট ভোগ করেন। ২০১৫ সালে আমেরিকাবাসী এ রাগের ভয়াবহতা টের পায়। এরপরের বছর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শহরটিতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে সে সময় জানিয়েছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। পরে ২০১১ সালে আবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঢাকার দোহারে এর প্রকোপ দেখা দেয়। তবে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি বছর ব্যাপক হারে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রোগীর কষ্টের সীমা নেই
চিকুনগুনিয়া রোগের কারণে জ্বর হয় এবং হাড়ের সন্ধিস্থলে ব্যথা হয়। অসুস্থতার কারণে অনেকে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছেন না। এজন্য নিন্ম আয়ের মানুষের উপার্জনও এখন বন্ধ। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী আল আমিন হোসেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই সপ্তাহ ভুগেছেন। তিনি বলেন, এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে, আমার ছুটি থাকা সত্ত্বেও বাড়ি যেতে পারিনি। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঢাকায় পড়ে ছিলাম। প্রথমে ব্যথা ছিল না, আস্তে আস্তে ব্যথা অনুভূত হয় এবং তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া একজন বেসরকারি কর্মজীবী সাইফ হাসনাত জানান, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের প্রথমে রোজার মাসে সেহরি খেয়ে ঘুমানোর ঘণ্টাখানেক পরে পিঠের দিকে হঠাৎ ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথাটা যেন পলকেই সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শরীর কাঁপিয়ে নেমে আসে জ্বর, সঙ্গে বমি বমি ভাব। জ্বরের প্রথম দিনটা কাটে বেহুশের মতো। নড়াচড়া পর্যন্ত করার শক্তি ছিল না। ১২ ঘণ্টার মধ্যেই শরীর দুর্বল হয়ে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। এক মাসেও ব্যথাটা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।
বর্ষা পর্যন্ত থাকছে চিকুনগুনিয়া
রাজধানীতে বৃষ্টি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ামুক্ত হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিন্মগামী নাকি ঊর্ধ্বগামী সে বিষয়ে তথ্য নেই জানিয়ে তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়া বেড়েছে না কমেছে এটা সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে তাই আমরা এডিস মশামুক্ত হব বা চিকুনগুনিয়ামুক্ত হব এমন পরিস্থিতি হয়তো হবে না। তবে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতক্ষণ বৃষ্টি বন্ধ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি কন্ট্রোলরুম চালু করা হয়েছে, কোথায় মশা আছে বা প্রতিরোধে কোন ওষুধ কাজ করবে- এসব বিষয় সমন্বিতভাবে কাজ করতে সহায়তা করা হবে এবং আরও জনসচেতনা প্রচার করা হবে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও সচেতনতায় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আজাদ।
দুই সিটি কর্পোরেশনে ব্যয় ৩০ কোটি টাকা
মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। নগরীর জলাবদ্ধতা, খোলা ড্রেন আর যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ হয়ে উঠেছে মশা প্রজননের অভয়ারণ্য। ফলে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু। এদিকে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর দাবি করলেও নগরবাসীর আঙ্গুল সিটি কর্পোরেশনের দিকেই। রাজউক, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার অসহযোগিতার কারণে মশানিধন কর্মসূচির সফলতা আসছে না বলে দাবি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের।
বর্ষা শুরুর আগ থেকেই রাজধানী জুড়ে মশার উপদ্রব বেড়েছে। মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর দাবি করলেও বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের চোখেই পড়ে না ওষুধ ছিটানোর বিষয়টি। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএমএম সালেহ ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সকাল সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম চলে ফলে অনেকের চোখে সেটা ধরা পড়ে না। একই রকম কথা বলা হয় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকেও। মশা নিধনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বাজেট ধরা হয়েছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধনে বাজেট ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যার পুরোটাই ব্যয় হয়েছে। নগরবাসীর প্রশ্ন ৩০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেও মশা নিধনে ব্যর্থ দুই সিটি কর্পোরেশন। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাউদ্দিন বলেন, আমরা প্রধানত জলাশয় ও নগরীর অলি-গলিতে বেশি ওষুধ দিয়ে থাকি। কর্মীরা যথেষ্ট কাজ করেন। উত্তর সিটির তুলনায় আমাদের এলাকায় মশা অনেক কম। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শেই কর্মীরা ওষুধ ছিটান।
নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা
সাধারণ জ্বরের মতো হলেও চিকুনগুনিয়া নিয়ে অনেকেই ভয়ে আছেন। এই ভাইরাস নষ্ট করে দেয় মানুষের কর্মক্ষমতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. এম মোজাহেরুল হক বলেন, যে কোনো অসুস্থতাই মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট করে। যদি কর্মক্ষম লোকের কর্মঘণ্টা ও কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়, তা হলে তার একটি প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ে। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের অধিকাংশই স্বাভাবিক কর্মস্পৃহায় ফিরে আসতে ২-৩ মাস সময় নেন। ফলে কর্মঘণ্টা নষ্টের বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। এক হিসাবে জানা গেছে, ২০১৪ সালে জ্যামাইকাতে চিকুনগুনিয়ায় শুধু বেসরকারি খাতের কর্মীদের ১ কোটি ৩০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৬শ কোটি ডলার।
টেস্টের নামে প্রতারণা
রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার টেস্টের নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা যুগান্তরকে বলেন, চিকনগুনিয়া জ্বরে রোগীর গায়ের তাপমাত্রা থাকে উচ্চ। সেই সঙ্গে শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে থাকে প্রচণ্ড ব্যথা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঘাবড়ে যান রোগী। ফলে অভিভাবকরা হাসপাতালে ছুটাছুটি করেন। দেশে দুই-একটি বেসরকারি হাসপাতাল আর আইইডিসিআর ছাড়া কোথাও চিকুনগুনিয়া টেস্টের ব্যবস্থা নেই। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস আক্রান্ত কি না এই পরীক্ষার নাম আরটিপিসিআর। আর বিভিন্ন হাসপাতালে যে টেস্টগুলো করা হচ্ছে সেগুলো মূলত এন্টিবডি টেস্ট। যা রোগীর জ্বর থাকা অবস্থায় করা যায় না। কাজেই বিষয়গুলোতে সাবধান হতে হবে। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কা নেই তবে উচ্চমাত্রার জ্বরে আক্রান্ত হলে আগে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় অবহেলার মাশুল
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান যুগান্তরকে বলেন, ফুলের টব, ফেলে রাখা কৌটা বা বোতল, ছাদে জমে থাকা পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, আবর্জনার স্তূপ, দই বা মিষ্টির প্যাকেটে জমে থাকা পানি থেকে জন্ম নিতে পারে এডিস মশা। তাই বাড়ির ভিতরে, বাড়ির ছাদে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। এই সিজনে প্রচুর ডাব বিক্রি হয়, ডাব খাওয়ার পর ডাবের খোসা যেখানে-সেখানে ফেলে রাখলে তাতে পানি জমে মশার প্রজনন ঘটায়। বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া দশ বছর আগে ধরা পরলেও কারো বিশেষ কোনো নজর ছিল না। আমরা বরাবরের মতোই পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য বলেছি। মশা-মাছি নিধনের জন্য বহু আবেদন-মানববন্ধন করেছি কিন্তু তাতে আশানুরূপ কোনো সাড়া ছিল না। এর মূল দায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের আর দুই সিটি কর্পোরেশন, তারা দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেনি। মশার ওষুধ এখন ছিটাচ্ছে, এভাবে আগে কেন ছিটায়নি? নাগরিক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও জবাবদিহিতা নেই। পরিবেশ রক্ষায় এই অবহেলার একটি মাশুল হল চিকুনগুনিয়া।
আইইডিসিআরের হটলাইন নাম্বার
আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তের চিকুনগুনিয়া রোগী এবং চিকিৎসকদের জন্য হটলাইন নাম্বার (০১৯৩৭-১১০০১১, ০১৯৩৭-০০০০১১)। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ নাম্বারে কল করে চিকুনগুনিয়া সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। রাজধানীর বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই স্বল্প পরিসরে একটা সার্ভে করা হবে।
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ২৩টি এলাকা
রাজধানীর ২৩টি এলাকাকে চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে রোগতত্ত্ব বিভাগ। এলাকাগুলো হল ধানমণ্ডি ৩২, ধানমণ্ডি ৯/এ, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়ের বাজার, শ্যামলী, মনিপুরী পাড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১, কড়াইল বস্তি, মহাখালী, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর ও উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এসব এলাকায় দেখা মেলে না মশা নিধন কর্মীদের। তবে দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলছেন, তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি পরিচালনা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.